নগরের বিপ্লব উদ্যানে সবুজ ধ্বংস করে ২০১৯ সালে গড়ে তোলা হয় বাণিজ্যিক স্থাপনা। এতে অপত্তি ছিল নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ লোকজনের। সে আপত্তি আমলে নেয়নি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। উল্টো ২০২৩ সালে উদ্যানটিতে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণে চুক্তি করে চসিক। এবারও কারো আপত্তি আমলে নেয়া হয়নি।
সর্বশেষ ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিপ্লব উদ্যান থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি ওঠে। এমনকি পৃথক যে দুই চুক্তির আলোকে বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হয় ওই চুক্তি দুটিও বাতিল এবং পূর্বে যে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিপ্লব উদ্যান ছিল সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি করা হয়। এছাড়া দ্বিতীয় দফায় চলা স্থাপনা নির্মাণ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর চসিককে অনুরোধ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
এ অবস্থায় বিপ্লব উদ্যান রক্ষায় উদ্যোগ নিচ্ছে চসিক। এর অংশ হিসেবে পরিবেশবাদী ও নগরপরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ নেবে সংস্থাটি। এছাড়া দ্বিতীয় ধাপে যে স্থাপনা নির্মাণ কাজ চলছে তা বন্ধ রাখতে ঠিকদারি প্রতিষ্ঠানকে গত ১৮ আগস্ট নির্দেশনা দেয়া হয়। এ বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, আমরা অনেকগুলো আবেদন পেয়েছি। এক্ষেত্রে প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশনা হচ্ছে সবার সঙ্গে বসে সবার মতামত নেয়া। পরিবেশবাদী ও নগরপরিকল্পনাবিদসহ সবার মতামত এবং আলোচনার প্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্ত আসবে সে আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জোরালো হচ্ছে চুক্তি বাতিলের দাবি : বিপ্লব উদ্যান রক্ষায় ৬ দফা দাবিতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতা অধিকার রক্ষা পরিষদ’ এর ব্যানারে দুই নম্বর গেট মোড়ে সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে। এতে বিপ্লব উদ্যানের সবুজ ধ্বংস করে চসিকের স্থাপনা নির্মাণ ও বাণিজ্যিকীকরণের চুক্তি বাতিল করা এবং উদ্যানের হারিয়ে যাওয়া সবুজ ফিরিয়ে আনার দাবি করা হয়। এছাড়া বিপ্লব উদ্যান থেকে বাণিজ্যিক স্থাপনা অপসারণের দাবিতে সম্প্রতি ‘বিপ্লব উদ্যান ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’ চসিকে লিখিত আবেদন করে। এতে বিপ্লব উদ্যান নিয়ে চসিকের সাথে সৌন্দর্যবর্ধন ও বিনিয়োগের চুক্তি বাতিলের দাবি জানানো হয়।
এর আগে ১৮ আগস্ট বৈষম্যবিরোরী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে চসিকে একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়। এতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষে বিপ্লব উদ্যানে নির্মাণাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতিকৃতি থেকে বঙ্গবন্ধুর সকল ছবি অপসারণ এবং শহীদদের নাম উল্লেখের দাবি করা হয়।
এছাড়া ১৪ আগস্ট মানববন্ধন করে বিপ্লব উদ্যান দোকান মালিক সমিতি। এতে তারা পরিবেশ ধ্বংস করে বিপ্লব উদ্যানে নতুন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং উদ্যানটি রক্ষায় উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবি জানান তারা। সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলেন, বিপ্লব উদ্যানে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কর্পোরেশন নতুন স্থাপনা নির্মাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই পার্ক চসিকের একার সম্পত্তি নয়, এটি জনগণেরও। এই পার্কের সুবিধা নগরবাসীও প্রাপ্য। নগরবাসীকে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে স্থাপনা গড়তে দেয়া হবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব প্ল্যানার্স চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান আজাদীকে বলেন, বিপ্লব উদ্যান একটা নাগরিক গণপরিসর। আমাদের চাওয়া গণপরিসরকে সম্পূর্ণভাবে গণপরিসরই রাখা হোক। আমরা চাই না কোনোভাবেই এখানে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হোক। বিপ্লব উদ্যান যে স্থানে অবস্থিত তার চারপাশে খাবারের দোকান এবং বাণিজ্যিক স্থাপনা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। তাই এখানে নতুন করে কোনো ফুড শপ, ফুড কর্নার বা অন্য কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করার যৌক্তিক কোনো প্রয়োজনীয়তা আমরা দেখি না। বিপ্লব উদ্যানের পরিপূর্ণভাবে প্রাকৃতিক যে পরিবেশ ছিল সেভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য আগেও দাবি জানিয়েছি। এখনও মনে করি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সিটি কর্পোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট সকল প্রশাসনেরই এ বিষয়ে কাজ করা উচিত।
তিনি বলেন, বিপ্লব উদ্যান সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগতভাবে যেমন ছিল ঠিক সেভাবে ফিরিয়ে আনা দরকার। সেক্ষেত্রে সকল অবকাঠামো, কংক্রিটের যে স্থাপনা, কংক্রিটের যে জঞ্জাল তৈরি করা হয়েছে তার সবগুলোই পরিষ্কারের দাবি জানাই।
বিপ্লব উদ্যান দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হুমায়ুন কবির আজাদীকে বলেন, বর্তমানের পার্কের মাত্র ১০ শতাংশ জায়গায় স্থাপনা আছে। সাবেক মেয়ক নতুন করে গত বছর যে চুক্তি করে এতে পার্ক নষ্ট হবে। তাই আমরা চাই নতুন বাণিজ্যিক স্থাপনার চুক্তি বাতিল করা হোক। এ ব্যাপারে আমরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) কার্যকর হস্তক্ষেপ কমনা করছি। উদ্যান কোনো প্রতিষ্ঠানের নয়, এটি নগরবাসীর। চট্টগ্রাম শহরের বুকে এমন পার্কের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু এটি এখন হুমকির মুখে পড়েছে। নতুন স্থাপনা নির্মাণের কারণে ছোট–বড় এবং কিছু প্রবীণ বৃক্ষ কাটা হয়েছে। ফলে পার্কটিকে তারা মরুউদ্যানে পরিণত করেছে। একমাত্র সিটি কর্পোরেশনই পারে প্রকৃতির এই বিরুপ প্রভাব হতে নগরবাসীকে উদ্ধার করতে।
আপত্তি পরিবেশ অধিদপ্তরের : গত ৫ সেপ্টেম্বর চসিকের প্রধান নির্বাহী, সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষককে পৃথক তিনটি পত্র দেয়া হয় চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে। এসব পত্রে বলা হয়, বিপ্লব উদ্যানে দ্বিতীয় দফায় সৌন্দর্য বর্ধনের নামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণসহ বৃক্ষ নিধন কাজ চলমান রয়েছে। স্থাপনা নির্মাণের দ্বারা উদ্যান এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার অবক্ষয়–ক্ষতির আশংকা রয়েছে। তাই এ বিষয়ে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়।
যেভাবে ধ্বংস হল সবুজ : ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড ও রিফর্ম লিমিটেড নামে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চসিক। বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে করা ২০ বছর মেয়াদি ওই চুক্তির পর উদ্যানে গড়ে তোলে ইট–কংক্রিটের অবকাঠামো। পার্কে নির্মাণ করা ২০টি দোকান তার প্রমাণ। এরপর ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট নতুন করে চুক্তি করে চসিক। এবার অবশ্য রিফর্ম কনসোর্টিয়াম নামে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তির পর প্রতিষ্ঠানটি কাজও শুরু করে। লোহার বিভিন্ন স্ট্রাকচারও নির্মাণ করা হয়।
পরবর্তীতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লব উদ্যানে চলমান নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার জন্য চসিক মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, সিএমপি কমিশনার এবং তিন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে নোটিশ দিয়েছে উদ্যানটিতে বিদ্যমান দোকানের ১২ মালিক। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিপ্লব উদ্যান চত্বরে সমস্ত নির্মাণকাজ বন্ধ করতে বলা হয়। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়। পরবর্তীতে গত ৪ জুলাই বিপ্লব উদ্যানে সকল ধরনের নতুন স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট। এরপ্রেক্ষিতে গত ১৮ আগস্ট রিফর্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বিপ্লব উদ্যানে কোনোরুপ নির্মাণ কাজ না করার নির্দেশনা দেয়।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুকের নেতৃত্বে ‘চট্টগ্রাম নগরীর পার্ক ও ওপেন স্পেস’ সম্পর্কিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দোকান ছাড়া বিপ্লব উদ্যানে কংক্রিটের অবকাঠামো আছে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ। দোকানসহ তার পরিমাণ ৬৫ থেকে থেকে ৭০ শতাংশ। এখানে সবুজ আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। সবুজ অংশের ভিতর রয়েছে কিছু বড় গাছ এবং কিছু আর্টিফিসিয়াল গাছ ও ঘাস। এ গবেষণার পর দ্বিতীয় ধাপে বেশ কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা হয় বিপ্লব উদ্যানে। ফলে সেখানে সবুজের পরিমাণ আরো কমেছে।