পরিকল্পনামাফিক কিছুই হচ্ছে না দেশের জ্বালানি খাতের বিপণনকারী তিন প্রতিষ্ঠানের ৩০০ কোটি টাকার ভবন নির্মাণ প্রকল্পের। তার উপর ‘কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম’ করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা প্রকল্পগুলোর। পদ্মা অয়েলের ২২ তলা ভবনের মধ্যে ৯ বছরে ৭ তলা হওয়ার পর পাল্টানো হচ্ছে নকশা। ৬২ কোটি টাকার মেঘনা ভবন নির্মাণ করতে অতিরিক্ত আরো ৩৫ কোটি টাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে। আর ঠিকাদারের আর্থিক সংকটেও শম্ভুকগতি যমুনা ভবন প্রকল্পে। অভিযোগ রয়েছে, দুর্বল পরিকল্পনার কারণেই স্থবির হয়ে পড়ছে পদ্মা মেঘনা যমুনা অয়েলের এসব ভবন নির্মাণ কাজ।
এবিষয়ে বিপিসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আজাদীকে বলেন, সরকারি কাজগুলোর যখন প্রস্তাবনা হয়, ভৌত কাজ শুরু হয় তারও অনেক পরে। সেজন্য প্রস্তাবনা তৈরির সময় বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে তৈরি করতে হয়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার প্রকল্পগুলো ৫ থেকে ৯ বছর আগে নেয়া। স্বাভাবিকভাবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। বেড়েছে কনসালটেন্সি ব্যয়। ফলে স্ট্যাকচারাল কাজের ব্যয়ও বেড়েছে। এতে ঠিকাদাররা কাজে গড়িমসি করছেন। দূরদর্শী প্রস্তাবনা হলে কাজগুলো নির্ধারিত সময়ে করা যেতো। তখনতো প্রকল্প চলমান থাকা অবস্থায় ১০ শতাংশ যোজন-বিয়োজন করা যায়। বেশি খরচের প্রয়োজন হলে তা করা সম্ভব হয় না। ফলে প্রকল্প আটকে যায়।
কনস্ট্রাকশন অব হেড অফিস বিল্ডিং অব পদ্মা অয়েল কোম্পানি- ২০১৩ সালে পদ্মা অয়েলের প্রধান কার্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বিপিসি। প্রথম পর্যায়ে ৬৭ কোটি ৬৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকায় “কনস্ট্রাকশন অব হেড অফিস বিল্ডিং অব পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড” নামের প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রকল্পটির পরিসর বাড়িয়ে ১০১ কোটি ৯০ হাজার টাকায় প্রকল্পটি ২০১৭ সালে পুনরায় অনুমোদন দেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ২৬ তলা ভবনটি (বেজম্যান্টসহ) নির্মাণে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৯২ কোটি ৫০ লাখ টাকায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। কাজ শুরু করে প্রায় সাড়ে চার বছরে এক তৃতীয়াংশ কাজও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে প্রকল্প ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। নগরীর আগ্রাবাদে ভবনটি নির্মিত হচ্ছে।
এদিকে ভবনের পাইলিং বেজম্যান্ট ঢালাই কাজ শেষ হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর আগ্রহে নতুন করে নকশা পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নিয়েছে পদ্মা অয়েল কোম্পানি। বেজম্যান্ট ঠিক রেখে নকশা পরিবর্তনে কনসালটেন্ট নিয়োগের জন্য ইতোমধ্যে টেন্ডারও আহবান করেছে পদ্মা অয়েল। আগ্রহী ১১টি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিয়েছে। কনসালটেন্ট নিয়োগে জন্য গত ১৯ নভেম্বর টেকনিক্যাল কমিটির মিটিংও হয়েছে। আমেরিকান এক জয়েন্ট ভেনচার কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বস্ত একটি সূত্র। ৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ পর্যন্ত কত টাকায় শেষ হয় তা নিশ্চিত করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কেউ।
প্রকল্প পরিচালক পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক নোমান আহমদ তাপাদার বুধবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পদ্মা অয়েলের হেড অফিসটি ২০১১ সালে ডিজাইন করা। এখন নির্মাণ শিল্পে অনেক আধুনিকতা এসেছে। যে কারণে নতুন করে আর্কিটেকচারাল ডিজাইন করতে কনসালটেন্ট নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রকল্পটির প্রায় ৩১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রজেক্টের কনসালটেন্টের বেতনসহ প্রকল্প কাজের ২৪ শতাংশের বিল হিসেবে ঠিকাদারকে ৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
কনস্ট্রাকশন অব ১৯ স্টোরিড মেঘনা ভবন- বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মেঘনা ভবন নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালে অনুমোদন পাওয়া নগরীর আগ্রাবাদে ১৯তলা বিশিষ্ট মেঘনা ভবন নির্মাণ কাজটি বন্ধ রয়েছে প্রায় ৯ মাস ধরে। নির্মাণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত তিন বছরে প্রকল্পের মাত্র ১৬ শতাংশ কাজ হয়েছে। প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এএনজেড প্রপার্টিজ। এদিকে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পক্ষ থেকে কোভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও খোঁজ নিয়ে মিলেছে ভিন্ন কথা। প্রায় ৬১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হলেও পুরো প্রকল্পটি শেষ করতে নতুন করে আরো ৩৫ কোটি টাকা লাগতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বস্ত একটি সূত্র। যেকারণে লোকসানের ভয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এখন প্রকল্প নির্মাণ কাজ থেকে পিছু হটছে।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিজিএম (পিএণ্ডই) ও প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুন নুর দৈনিক আজাদীকে বলেন, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে থেকে প্রজেক্টের কাজ বন্ধ রয়েছে। ঠিকাদার ইতোমধ্যে আর কাজে হাত দেয়নি। এখন ঠিকাদার তাদের সমস্যার কথা বলেছেন। আমাদের নতুন চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে ঠিকাদার মিটিং করেছেন। তারা তাদের সমস্যার কথা লিখিতভাবে জানাবেন। ঠিকাদারের সাথে আমাদের এখনো কন্ট্রাক্ট আছে। কন্ট্রাক্ট ফেল করলে হয়তো আবার পুনরায় প্রাক্কলন করতে হবে। এই প্রকল্পের প্রাক্কলন করেছেন বুয়েটের প্রকৌশলীরা, পুনরায় প্রাক্কলন করলে তারাই (বুয়েট) করবেন। পুরো প্রকল্পে ১৬ শতাংশের মতো কাজ শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮ কোটি টাকার মতো বিল পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কনস্ট্রাকশন অব ২০ স্টোরিড যমুনা অফিস বিল্ডিং প্রজেক্ট- ২০১৫ সালে নেয়া ঢাকার কাওরান বাজারে যমুনা অয়েলের অফিস ভবন (যমুনা ভবন) নির্মাণ প্রকল্পটিও এগুচ্ছে শম্ভুকগতিতে। প্রায় ১৫৪ কোটি টাকার প্রকল্পের দুই পর্যায়ে ৫০ কোটি টাকার প্রথম পর্যায়ের কাজ ( বেজমেটসহ প্রথম ও দ্বিতীয় তলা) শেষ হলেও প্রায় ১০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের (তৃতীয় তলা থেকে ২০ তলা) কাজটিও এগুচ্ছে ডিমেতালে। দেশের খ্যাতনামা শিল্পগ্রুপ নাভানা কন্সট্রাকশন যমুনা অয়েলের ভবন নির্মাণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের এ নির্মাণ কাজ করছিলেন। তৃতীয় তলা থেকে ২০ তলা পর্যন্ত ভবনের কন্সট্রাকশন কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ থাকলেও ১৪তলা পর্যন্ত ঢালাই কাজ হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ১০৩ কোটি টাকার দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের মাত্র ২৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এ পর্যন্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে ২১ কোটি টাকার কিছু বেশি।
প্রকল্প পরিচালক যমুনা অয়েলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মাহিদুর রহমান বুধবার সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘যমুনা ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ নেই। তবে ধীরগতিতে চলছে। আমরা শুনেছি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নাভানা কন্সট্রাকশনের অর্থ সংকট রয়েছে। আবার আমরা কাজের জন্য অগ্রিম বিলও দিতে পারি না। ইতোমধ্যে ১৪ তলা পর্যন্ত ঢালাই কাজ শেষ হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ কোভিডের কারণেও ভবন নির্মাণের গতি অনেকটা কমে গেছে। আগামী জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলে হয়তো বিকল্প পদক্ষেপ নিতে হবে।’