বর্তমান অর্থবছর ২০২২–২৩ এ বাংলাদেশের বাজেটে মোট ব্যয় হলো ৬ লাখ ৭৮ হাজার ০৬৪ কোটি টাকা। আয় হলো ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার ০৬৪ কোটি টাকা। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ও কর ব্যতিত প্রাপ্তি হলো ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের কর ব্যতিত প্রাপ্তির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের তেল বিক্রির লভ্যাংশ থেকে। শুধু তাই নয় এনবিআরের আহরণকৃত শুল্কেরও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে বিপিসির আমদানিকৃত তেলের শুল্ক থেকে। তাই বিপিসি বাংলাদেশের বাজেটে অর্থপ্রাপ্তির একটি প্রধানতম খাত। অথচ বছরের পর বছর ধরে এই খাতে চলছে নানা অনিয়ম। এটি আমার কথা নয়, জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির কথা। গত ২৩ শে অগাস্ট ‘২২ জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিপিসির নানা অনিয়ম ও নিরীক্ষা আপত্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ। এতে বিপিসির তিন অর্থ বছরের অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা (অডিট) আপত্তির কথা উঠে এসেছে। যার সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা জড়িত। কমিটির বৈঠকে একটি নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে আলোচনা হয় যাতে বলা হয়, অকার্যকর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ এবং যথাযথ প্রত্যক্ষ তদারকির অভাবে বিপিসির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ঐদিন জাতীয় সংসদ ভবনে বিপিসির অনিয়ম ও বিভিন্ন নিরীক্ষা আপত্তি নিয়ে সংসদীয় কমিটির সভা হয়। সভায় বিপিসির ২০০৯–১০, ২০১০–১১ ও ২০১১–১২ অর্থবছরের অনিষ্পন্ন নিরীক্ষা আপত্তিগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। এসব আপত্তির সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা জড়িত। একটি আপত্তিতে হিসাব ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলেছে, বিপিসির স্থিতিপত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে দেওয়া ঋণের যে পরিমাণ দেখানো হয়েছে, ওই সব প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের স্থিতিপত্রে দেখানো অঙ্কে ২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকার গরমিল দেখা যায়। নিরীক্ষার সময় বিপিসি এই গরমিলের ব্যাপারে কোনো জবাব দিতে পারেনি। ইতিপূর্বে নিরীক্ষায় অনুসন্ধান করে এই গরমিলের সঙ্গে কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বিপিসি এই বিষয়েও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। পরে ওই আপত্তি জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠানো হয়। গত ২২ মে ‘২২ কমিটি দুই মাসের মধ্যে নিরীক্ষা অধিদপ্তরে নথিপত্র জমা দিতে বিপিসিকে নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু তারা কমিটিকে কোনো নথিপত্র সরবরাহ করেনি। অন্যদিকে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ২০১২–১৩ অর্থবছরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, আর্থিক বছর শেষ হওয়ার পরেও বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করেনি বিপিসি, যা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। প্রতিবেদনে নির্ধারিত সময়ে বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত না করায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি। আরো অবাক করার বিষয় হলো তারা দুদকের কথাও শুনেন না। কি পরিমান ক্ষমতার অধিকারী হলে তারা এতোটা বেপরোয়া হতে পারে, তা ভাবতেও অবাক লাগে?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিপিসি এখনো জাহাজ থেকে ম্যানুয়েলি তেল খালাস করে। ম্যানুয়েলি তেল সরবরাহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন স্থাপনের প্রক্রিয়া অজ্ঞাত কারণে থেমে আছে। অথচ তেল পরিবহনে তাপমাত্রা জনিত ও অন্যান্য অবচয়ে কোটি কোটি টাকা নয় ছয় হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবু এই বিষয়ে বিপিসি কর্তৃপক্ষের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।
বৈঠকের আলোচনায় দেখা যায়, ২০১২–১৩ অর্থবছরে দেশে মজুত ধারণক্ষমতার বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করায় বাড়তি সময় জাহাজ ফ্লোটিং করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এতে বিপিসির ৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। একই অর্থবছরে ব্যাংকে নিজস্ব তহবিল থাকা সত্ত্বেও ঋণ (ওভার ড্রাফট) নিয়ে কেনাকাটা করায় সুদ বাবদ প্রতিষ্ঠানের ২৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এখনো ২০১৩–২০২২ অর্থ বছরগুলোর হিসাব উপস্থাপিত হয়নি। তাই এই বছরগুলোতে কী কী অনিয়ম হয়েছে তা এখনো অজানা।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে গত ১০ বছরের লাভক্ষতির হিসাব তুলে ধরে বিপিসি। এতে বলা হয়, ২০১৪–১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০–২১ অর্থ বছর, এই সাত বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। তবে এর আগের তিন অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে দেশে জ্বালানি তেল আমদানির সঠিক কোনো তথ্যও নেই। কারণ বিপিসি ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র সরাসরি তেল আমদানি করে। জ্বালানি বিভাগের হিসাব এক রকম আর বিপিসি হিসাব আরেক রকম। ফলে জ্বালানি তেল বিক্রির সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। বর্তমানে দুই হিসাবে গরমিল প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ মেট্রিক টনের, যার বাজার মূল্য কয়েকশ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের বৈদেশিক দেনা–বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) প্রকাশিত ‘এনার্জি ডেটা ম্যানেজমেন্ট: চ্যালেঞ্জেস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ–জ্বালানি খাতের ভুলের তথ্য বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগের বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি বিক্রির হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০২০–২১ অর্থবছর বিপিসির হিসাবে দেশে আট ধরনের জ্বালানি পণ্য বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ মেট্রিক টন। আর জ্বালানি বিভাগের হিসাবে ওই আট ধরনের জ্বালানি পণ্য বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৬ লাখ ৩৯ হাজার ৭৩৯ মেট্রিক টন। অর্থাৎ দুই হিসাবের পার্থক্য ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ১১৭ মেট্রিক টন।
এদিকে ডলার সংকটে দেশে জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খুলতে জটিলতায় ভুগছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তাই তারা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশি ঋণ নিতে চায়। যদিও এই ঋণ নেওয়ার উদ্যোগে আপত্তি জানিয়েছে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তারা বলছে, বিপিসি ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) নামে যে সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিতে চায়, তাদের সুদের হার বেড়ে গেছে। ছয় মাস আগে যেখানে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যেত, সেটা এখন পড়বে সাড়ে ৫ শতাংশের মতো। বিষয়টি এখন গড়িয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ইআরডি এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে। ইআরডির মতামত হলো, বিপিসিকে এরই মধ্যে ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। তাই নতুন করে এখন চড়া সুদে এই ঋণ না নেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে ইআরডি। তারা বলেন, এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে সরকার যে ঋণ চেয়েছে, তা যদি শিগগিরই না পাওয়া যায়, তাহলে বিকল্প উৎস ভাবা যেতে পারে। তবে বিপিসির কর্মকর্তাদের অভিমত হলো, দেশে জ্বালানি তেল আমদানি করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত ও ৪০ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে মাসে গড়ে তাদের ১৫ থেকে ১৬টি ঋণপত্র খুলতে হয়। দেশে যে ডলার সংকট চলছে, তাতে কয়েক মাস ধরেই ঋণপত্র খোলা নিয়ে বিপিসি জটিলতায় পড়ছে। বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিময় হার ধরে সরকারি বেসরকারি ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছে না। তাদের দিয়ে ঋণপত্র খোলাতে নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তদবির করতে হয়। এমনকি বেসরকারি ব্যাংকে বাড়তি দামে ডলার কিনেও কিছু ঋণপত্র খুলতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা কঠিন হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের মত আমদানি নির্ভর দেশে জ্বালানি তেলের সরবরাহ ঠিক রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এইটি এমন একটি পণ্য যার উপর দেশের অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতি নির্ভরশীল। তাই তেলের আমদানি ও সরবরাহ ঠিক রাখতে হলে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার সহিত বিপিসির কার্যক্রম পরিচালনার কোনও বিকল্প নেই। প্রয়োজন বোধে বিদেশী ব্যাংকে বৈদেশিক মূদ্রার হিসাব খুলে তাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা স্থিতির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ বিপিসি তেল আমদানি করে বৈদেশিক মুদ্রায় আর তেল বিক্রি করে দেশীয় মুদ্রায়। তাই বিপিসির হাতে নগদ দেশীয় মুদ্রা থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রার ক্রাইসিস থাকা স্বাভাবিক। তাই বিপিসির আর্থিক খাতের হিসাব নিকাশ হালনাগাদ করা ও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মূদ্রার সংস্থান করে একে গতিশীল করা সময়ের দাবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট