সামাজিক অবক্ষয়সহ যে কোনো বিপর্যয় থেকে জাতিকে রক্ষা করতে সাংস্কৃৃতিক বিকাশের বিকল্প নেই। এ জন্য এই খাতে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে। দেশ থেকে উগ্রতা-সহিংসতার বীজ নির্মূল করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটাতে হবে। তা না হলে দেশ অগ্রসর হবে না।
অতি সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ‘সংস্কৃতির শক্তিতে জেগে ওঠো বাংলাদেশ’ শিরোনামে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের অষ্টম জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিল অধিবেশনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
তাঁরা আরো বলেন, সমাজে মানবিকতাবিরোধী শক্তি জেগে উঠেছে, যা রাষ্ট্র ও সমাজকে ধ্বংস করতে চায়। এর বিরুদ্ধে সংস্কৃতি কর্মীদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দেশের ইতিহাসে বারবার সংস্কৃৃতি কর্মীরা এ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন, আগামীতেও করতে হবে। তাঁরা বলেন, সংস্কৃতি কর্মীরা যখন এগিয়ে যান, তখন সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে। সংস্কৃতি কর্মীরা মানুষের দৃষ্টি খুলে দেন।
শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটাতে না পারলে দেশ এগোবে না। এটা সরকার, শিক্ষক, মা-বাবাসহ সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। আজও দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে অনেকেই নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরে। স্বাধীন দেশে এটা হতে পারে না। এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজে সামপ্রদায়িকতা যেভাবে ছড়িয়েছে, তা অকল্পনীয়। তাতে নৈতিকতার চরম ক্ষয় হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকের অবমাননা ঘটছে। দুর্নীতি হচ্ছে, বখাটেপনা ছড়াচ্ছে সমাজে। সংস্কৃতি কর্মীদের কাজ হবে সমাজের এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। শিক্ষাব্যবস্থাকে মানবিক করার সংগ্রাম করতে হবে। দেশ থেকে উগ্রতা-সহিংসতার বীজ নির্মূল করতে হলে আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে মানুষের মুক্তির পথে সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে জেগে উঠতে হবে। মানুষের মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে। স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে সমুন্নত রাখতে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে রূপ দিতে সংস্কৃতির শক্তি নিয়ে মানুষের জাগরণে আন্দোলনের বিকল্প নেই। প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন তাঁর এক লেখায় বলেছেন, জ্ঞান হলো অসীম এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হবে নানা আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে প্রাণবন্ত, মুক্ত, বিকাশমান। কিন্তু আমাদের সমাজমানসে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার এখনো দৃঢ়মূল শুধু নয়, যেটুকু জ্ঞানচর্চা হয় তা পদ্ধতির কারণে কার্যত বিশ্বাসে, কখনো অন্ধবিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। এভাবে বলা যায়, সমাজটা অনুসন্ধিৎসায়, যুক্তিতে তথা জ্ঞানের অজানা নতুন পথে দুঃসাহসী অভিযানের জন্য একেবারেই প্রস্তুত নয়। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও তাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সমাজ বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার অনুকূল নয়। আর নয় বলেই এখানে যেকোনো স্তর থেকে যেকোনো শিক্ষার্থী যেকোনো অন্ধবিশ্বাসে দীক্ষিত হতে পারে। ধর্মীয় চরম পন্থা, যা সমপ্রতি জঙ্গিবাদে প্রকাশ পাচ্ছে তার প্রচারণাকে প্রতিরোধের মতো পাল্টা যুক্তি-ভাবনা বর্তমান বিদ্যায় কুলাবে না। জ্ঞানের দিক থেকে এটি স্থবির এবং যেহেতু স্থবিরতা প্রাণজ বস্তুকে পচন ও ক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, তাই এ সমাজের অবস্থাও সে রকমই হচ্ছে। দালানকোঠা নির্মাণকেই গুরুত্ব দিচ্ছি; আরাম ও ভোগ, বিলাস ও বিনোদন গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রাণের বিকাশ, জ্ঞানের আনন্দ মোটেও পাত্তা পাচ্ছে না। এটা সংস্কৃতির সংকট, যা শিশুকাল থেকেই শিক্ষার মাধ্যমে পাওয়ার কথা। শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে, যেমন সব বিষয়ের থাকে। শিক্ষার সংস্কৃতির নিহিত চাহিদা হলো মুক্ত পরিবেশ, অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ, প্রকাশের স্বাধীনতা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দানবের সমাজ নয়, মানবের দেশ গড়তে হবে। তার জন্য মানুষের মনের আলো জ্বালাতে হবে। আর সেটার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চার বিকল্প নেই। মানবিক, মুক্তমনা, সহনশীল সমাজ গড়তে হলে সংস্কৃতি চর্চা জরুরি। সংগীত ও শিল্পকে অনুভব করার শক্তি, সংস্কৃতিকে মনে ধারণ করা শক্তিই হচ্ছে আলোকিত সমাজ গড়ার মূল মন্ত্র। সামাজিক অবক্ষয়সহ যে কোনো বিপর্যয় থেকে জাতিকে রক্ষা করতে সাংস্কৃতিক বিকাশের বিকল্প নেই।