বিনয় ও নম্রতা মুমিনের অনন্য সৌন্দর্য জান্নাতি মানুষের বৈশিষ্ট্য

ফখরুল ইসলাম নোমানী | শুক্রবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৪ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

বিনয় ও নম্রতা মানুষের চরিত্রে এমন এক অলংকার যা আল্লাহর নিকট প্রিয়। মানুষের মাঝে অনন্য মর্যাদা প্রদান করে এ বিনয়। মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের এই গুণের প্রশংসা করেছেন পবিত্র কোরআনে। বিনয় মানুষকে অহংকার থেকে মুক্ত রাখে এবং অন্যের প্রতি দয়া ও সহানুভূতির পথ দেখায়। বিনয় মানব জীবনের অনন্য সৌন্দর্য। বিনয়ী মানুষকে সবাই ভালোবাসে। বিনয়ের মাধ্যমে সহজে ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়। পবিত্র কোরআনে বিনয়ীদের আল্লাহর বন্ধু বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আছে তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ তাঁর রাসুল ও বিশ্বাসীরা যারা নামাজ কায়েম করে জাকাত দেয় ও বিনত থাকে। (সুরা মায়িদা: আয়াত: ৫৫) রাসুল (সা.) বলেছেন, যিনি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হন আল্লাহ তাঁকে মর্যাদাবান করেন। তখন তিনি নিজের চোখে তুচ্ছ হলেও মানুষের চোখে অনেক বড় বিবেচিত হন। যিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিনয় প্রকাশ করেন তাঁর কথাবার্তা ওঠাবসা হাঁটা চলায় মার্জিত ভাব আসে। পবিত্র কোরআনে আছে আর তাঁরাই করুণাময়ের (রহমানের বান্দা) যাঁরা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করেন এবং অজ্ঞ ব্যক্তিরা তাঁদের সম্বোধন করেন তখন তাঁরা বলেন শান্তি। (সুরা ফুরকান : আয়াত: ৬৩) তাঁরা অন্যের কটু কথা ও গালাগালের জবাব মন্দ কথায় না দিয়ে ভদ্র ভাষায় বিনয়ের সঙ্গে দিয়ে থাকেন।

আল্লাহতায়ালা তাঁর খাঁটি বান্দাদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে তারা প্রকৃত মুমিন, পরহেজগার, উন্নত আদর্শের অনুসারী, তারা বিনম্র পদক্ষেপে চলাফেরা করে, তারা কখনো অহংকার করে না তাদের মনে যেমন অহংকার থাকে না তেমনি তাদের চালচলনে কথাবার্তায় ওঠাবসায় কখনো অহংবোধ পরিলক্ষিত হয় না তারা রহমানের নাম শ্রবণ করে মুশরিকদের মতো মন্দ কথা বলার ধৃষ্টতা দেখায় না বিনীত বিনম্র নিরহংকার মুমিনদেরই আল্লাহ তার প্রকৃত বান্দা বলে ঘোষণা করেছেন। বিনয় শব্দের অর্থ নম্রভাব, নম্রতা, কোমলতা, মিনতি প্রভৃতি। নম্রতা শব্দের অর্থ বিনীত, ঔদ্ধত্যহীন, নিরহংকার, অবনত, নরম, কোমল, শান্তশিষ্ট প্রভৃতি। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) বলেছেন, বিনয় ও নম্রতার মূল হলো তুমি তোমার দুনিয়ার নিয়ামতের ক্ষেত্রে নিজেকে তোমার নিচের স্তরের লোকদের সঙ্গে রাখো যাতে তুমি তাকে বোঝাতে পারো যে তোমার দুনিয়া নিয়ে তুমি তার চেয়ে মর্যাদাবান নও। আর নিজেকে উঁচু করে দেখাবে তোমার চেয়ে দুনিয়াবী নিয়ামত নিয়ে উঁচু ব্যক্তির কাছে যাতে তুমি তাকে বোঝাতে পারো যে দুনিয়া নিয়ে সে তোমার ওপর মর্যাদাবান নয়। মুমিনের বিনয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়। তার কথাবার্তা, ওঠাবসা, হাঁটাচলা ও অন্যান্য প্রতিটি কাজেকর্মে। রাসূলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টি জগতের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মহান ও মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি বিনয়ী, রহমদিল ও সহমর্মী চিত্তের অধিকারী।

অহংকার ত্যাগ করে বিনয় ও নম্রতাকে আপন করে নেওয়া জরুরি। হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, আমি আদমসন্তানের সর্দার তবে এতে গর্বের কিছু নেই। কেয়ামতের দিন আমার কবরের মাটিই প্রথম সরানো হবে এটাও গর্বের কিছু নয়। সেদিন আমিই প্রথম সুপারিশ করব আমার সুপারিশই প্রথম গৃহীত হবে; এতেও অহংকার করার কিছু নেই। সেদিন ‘হামদ’এর পতাকা আমার হাতে থাকবে তাতেও কোনো বড়াই নেই। মানুষের জীবনে যত উত্তম গুণাবলী রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম উত্তম গুণ হলোবিনয় ও নম্রতা। বিনয় ও নম্রতা মানুষের উত্তম চরিত্রের ভূষণ ও অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনয় মানুষকে উচ্চাসনে সমাসীন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সহায়তা করে। বিনয়ী ব্যক্তিকে আল্লাহ যেমন ভালোবাসেন, তেমনি মানুষও তাকে ভালোবাসেন।

বিনয় ও নম্রতা শুধু একটি নৈতিক গুণ নয় এটি একজন মুমিনের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহতাআলা বিনয়ী বান্দাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। অহংকারীকে অপমানিত করেন। আমাদের উচিত রসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবন থেকে এই গুণ শিখে নিজেদের জীবনকে বিনয়ী এবং নম্রতার আদর্শে গড়ে তোলা। রাসুল (সা.) বলেছেন প্রত্যেক আদম সন্তানের মাথার পেছনে একজন বিশেষ ফেরেশতা থাকেন। তাঁর হাতে থাকে একটি হাকামাহ নামের বিশেষ বস্ত। যখনই বান্দা বিনয় অবলম্বন করে তখন ওই ফেরেশতাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয় হাকামাহ ওঠাও। অর্থাৎ তাঁর মর্যাদা বাড়িয়ে দাও। আর যখনই বান্দা অহংকার করেন তখন বলা হয় হাকামাহ ছেড়ে দাও। অর্থাৎ তাঁকে অপমানিত করো। বিনয় ও নম্রতার আদেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন তুমি মাটিতে দেমাক করে পা ফেলো না। তুমি মাটিও ফাটাতে পারবে না পাহাড়ের সমান উঁচুও হতে পারবে না। (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত: ৩৭) নবী করিম (সা.) এর আচরণ ছিল বিনয় ও নম্রতার অনন্য উদাহরণ। হাদিসে আছে তিনি ছিলেন সুবিশাল হৃদয়ের মহানুভব। সত্যবাদিতায় সর্বাগ্রে নম্রতা আর কোমলতায় অনন্য আচারআচরণে অভিজাত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। দোজাহানের বাদশাহ হয়েও তিনি কখনো কারো সঙ্গে অহংকার দেখাননি বরং প্রত্যেক মানুষকেই তার প্রাপ্য সম্মান দিয়েছেন। যিনি প্রথম তাঁকে দেখতেন ভয় করতেন। কিন্তু যিনি তাঁর সঙ্গে মিশতেন তাকে ভালোবাসতে শুরু করতেন।

আল্লাহর রাসুলের বিনয় ও নম্রতার কথা কোরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন। আপনি যদি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার কাছ থেকে সরে পড়তো। (সুরা আলে ইমরান: আয়াত: ১৫৯) অহংকার ত্যাগ করে বিনয় ও নম্রতাকে আপন করে নেওয়া সর্বাত্মক জরুরি। প্রতিটি আচরণে ও উচ্চারণে বিনয় মুমিনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। রাসুল (সা.) বলেন, মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়। অন্যত্র রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের জান্নাতি মানুষের সংবাদ দেব না? আর তারা হলো সরলতার দরুণ দুর্বল প্রকৃতির লোক। মানুষ তাদের হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোনো বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। রাসুল (সা.) আরো বলেন, আমি কি তোমাদের জাহান্নামিদের সংবাদ দেব না? আর তারা হলো প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী বদমেজাজি ও অহংকারী। অতএব আমাদের জীবনকে সুখময় করে তুলতে সবার প্রিয় পাত্র হতে সবশেষে জান্নাতিদের দলে শামিল হতে অবশ্যই আমাদের বিনয়ী হতে হবে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের সাথে এভাবে মিলেমিশে বসতেন যে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করা ব্যতীত চিনতে পারত না। একবার সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন: আপনি এমন কোনো স্থানে আসন গ্রহণ করুন যেন অপরিচিত ব্যক্তিও আপনাকে চিনে নিতে পারে। সুতরাং এই উদ্দেশ্য পরিপূরণের লক্ষ্যে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে একটি মাটির উঁচু ঢিবি বা মঞ্চ বানিয়ে দিয়েছিলেন। বিনয় আর নম্রতা মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানিয়ে দেয়া বিনয়ের গুরুত্বপূর্ণ পথ অবলম্বন করা ছাড়া মানুষ তার অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সক্ষম হয় না। বিনয় জীবনের এমন এক অনুষঙ্গ যে যদি কেউ তা অবলম্বন না করে তাহলে তার জীবনমরুতে অহংকার বালু তপ্ত হয়ে উঠে। একজন সফল ব্যক্তি তাকেই বলা যায় যার মাঝে দয়া, সাহস, ন্যায়পরায়ণতা, সহমর্মিতার পাশাপাশি বিনয়, নম্রতা, সততা ও নৈতিকতার গুণ থাকে। আর বিনয় ও নম্রতার বিপরীত শব্দ হলো ঔদ্ধত্য, কঠোরতা, অহংকার, হিংসাবিদ্বেষ ইত্যাদি। এগুলো মানব চরিত্রের সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বভাব। এ পৃথিবীতে মারামারি, কাটাকাটি, খুনরাহাজানি সহ যত অশান্তির সৃষ্টি হয় তার মূলে রয়েছে ঔদ্ধত্য, অহংকার, হিংসাবিদ্বেষ ইত্যাদি। আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হতে চাইলেও বিনয় আবশ্যক। যে বিনয়কে নিজের ভূষণ বানিয়ে নেবে দুনিয়া ও আখেরাতে তার সম্মান বাড়বে। মানুষের ভালোবাসায় সে সিক্ত হবে আল্লাহর নৈকট্য লাভেও ধন্য হবে। মহান আল্লাহ আমাদের বিনয়ী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের ভেতরটা দেখতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসুফি-আউলিয়ার দরবার : সকল সমপ্রদায়ের নিরাপদ আশ্রয়স্থল