বিদেশে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

একজন ডাক্তার মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করে যা বেতন পান তার উপর আয়কর দেন। এর বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে মাসে যে লাখ লাখ টাকা আয় করেন ওখান থেকে যৎসামান্য টাকা ট্যাঙ ফাইলে দেখিয়ে আয়কর দেন। বাকী টাকা ট্যাঙ ফাইলে না দেখানোর কারণে অপ্রদর্শিত আয় বা ব্লেক মানিতে পরিণত হয়। একইভাবে একজন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ছাত্রী পড়িয়ে বা কনসালটেন্সি করে অনেক টাকা আয় করেন। আবার একজন ইঞ্জিনিয়ার যিনি চাকরি ক্ষেত্রে সৎ, কনসালটেন্সি করে লাখ লাখ টাকা আয় করেন। কিন্তু আয়ের সব টাকা ট্যাঙ ফাইলে দেখান না। ফলে ট্যাঙ ফাইলে না দেখানো টাকা অপ্রদর্শিত আয়ে পরিণত হয়। আবার কিছু মানুষ আছে যারা ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, হুন্ডি ব্যবসা ও চোরাচালান করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন। অবৈধভাবে অর্জিত এই আয়ও ব্ল্যাক মানি। অর্থাৎ বৈধ বা অবৈধ দুইভাবে অর্জিত টাকাই ব্ল্যাক মানি, যদি তা ট্যাঙ ফাইলে দেখিয়ে আয়কর দেওয়া না হয়। এভাবে অপ্রদর্শিত টাকাই শেষ পর্যন্ত বিদেশে পাচার করা হয়। এই পাচারের সাথে সব শ্রেণী পেশার মানুষ জড়িত।একটু খেয়াল করলে দেখবেন দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীদের অনেকের ছেলে মেয়ে বিদেশে থাকে ও স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাদের পড়ার ও পরিবারের দৈনন্দিন খরচ এই দেশ থেকে পাঠানো হয়। তারা মনে করেন তাদের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ বিদেশে, বাংলাদেশে নয়। তাঁরা দেশে ইনকাম করে বিদেশে গিয়ে খরচ করেন। সেজন্য কানাডায় “বেগম পাড়ার” মত এলাকা গড়ে উঠেছে এবং হয়ত এই ধরনের এলাকা অন্যান্য দেশেও আছে।
বিশ্বব্যাপী কালোটাকার সবচেয়ে বড় গবেষক জার্মান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফ্রেডরিক স্নাইডার মনে করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কালো অর্থনীতি তৈরী হচ্ছে মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও কর কাঠামোর অব্যবস্থার কারণে। তাঁর সমীক্ষা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশী কালোটাকা আছে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে, সাব সাহারা আফ্রিকা ও এশিয়ায়। তার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ২৮%।বাংলাদেশেও ২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছিলো।”বাংলাদেশের অপ্রকাশ্য অর্থনীতির আকার-একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ “নামের এই সমীক্ষায় ১৯৭৩ হতে ২০১০ সালের সময়কে বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল।সে অনুযায়ী সেই সময়ে বাংলাদেশে কালোটাকা ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে দেশে এ পর্যন্ত ২০ বার কালোটাকা সাদা করার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জরিমানাসহ মাত্র ১৮ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়।এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী ১০% জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যায়।কিন্তু মানুষ ১০% জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা না করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচারকে অধিক লাভজনক মনে করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, একজন লোক বৈধ বা অবৈধ যে ভাবেই হোক টাকা আয় করে যদি ট্যাঙ না দেন তাহলে তা আইনের দৃষ্টিতে একই অর্থাৎ কালো টাকায় পরিণত হয়। এক্ষেত্রে টাকাটি বৈধ নাকি অবৈধভাবে আয় করা হয়েছে, সেটা বিবেচ্য নয়।
তাহলে অপ্রদর্শিত সেই বিপুল পরিমাণ কালোটাকা গেল কোথায়? সেই টাকাগুলোই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। অবৈধ অর্থের লেনদেন নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) এর সবশেষ তথ্যানুযায়ী, অর্থ পাচারে বিশ্বের সর্বোচ্চ ৩০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। যা সত্যি দুঃখজনক ও হতাশাজনক।আচ্ছা বলতে পারেন, মানুষ কেন দেশ থেকে টাকা পাচার করে? কেন একটা বয়সের পর ঐসব দেশে পাড়ি জমায়? কারণ তারা দেশকে নিরাপদ মনে করেন না। অথচ এ দেশ থেকেই তারা কোটি কোটি টাকা আয় করেন। জেএফআইর হিসাব মতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশী অবৈধ অর্থ আসে ঘুষ, দুর্নীতি, জাল পণ্য কেনাবেচা, মাদক ব্যবসা ও মানব পাচার থেকে। আমাদের দেশেও এই সব খাতে একশ্রেণির মানুষ প্রচুর টাকা আয় করে, যা পরবর্তীতে বিদেশে পাচার করা হয়। এর সাথে আছে আমলাদের ঘুষের টাকা। যদিও সরকার প্রায় প্রতি বছর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। কিন্তু এরপরেও অবৈধ টাকা পাচার বন্ধ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত দেশে কালো টাকা বিনিয়োগ শেয়ার মার্কেট, জমি, বাড়ী ও ফ্লাট কেনায় সীমাবদ্ধ। তাই এই সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পর বাকী টাকা তারা কানাডা, আমেরিকা বা ট্যাঙ হেভেন নামে পরিচিত কোন দেশে পাচার করে। আবার অনেকে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেন। যার পরিমাণ ২০০৪ সালে ছিল ৩৬৫ কোটি টাকা, ২০০৫ সালে ৮৬৩ কোটি, ২০০৬ সালে ১১০৬ কোটি, ২০০৭ সালে ২১৮৭কোটি, ২০০৮ সালে ৯৫২ কোটি, ২০০৯ সালে ১৩২৬ কোটি, ২০১০ সালে ২১০০ কোটি, এভাবে প্রতি বছর বাড়তে বাড়তে ২০১৯ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৫,৩৬৭ কোটি টাকায়। বর্তমানে সুইস ব্যাংকে সবচেয়ে বেশী টাকা আছে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের। এরপরে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ওয়েস্ট ইন্ডিজ,ফ্রান্স ও হংকং এর নাগরিকদের। এতে বাংলাদেশের অবস্থান হলো ৮৫তম, ভারতের ৭৭তম, পাকিস্তানের ৯৯তম, নেপালের ১১৮তম, শ্রীলঙ্কার ১৪৮তম ও ভুটানের ১৯৬তম। প্রশ্ন হলো মানুষ কেন সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে? কারণ সুইজারল্যান্ডে ১৯৩৪ সালের “সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট” আইন অনুযায়ী কোন গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করতে পারে না।এই একটি নিশ্চয়তার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ তাদের বৈধ অবৈধ জমানো সব টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রাখে।
অন্যদিকে ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশ হতে ক্রমবর্ধমান হারে টাকা পাচার বেড়েছে। যেমন ২০০৪ সালে পাচারকৃত অর্থ ছিল ২৮,৪৭৫ কোটি টাকা,২০০৫ সালে ৩৬২১০ কোটি,২০০৬ সালে ২৮৭৩০ কোটি,২০০৭ সালে ৩৪৭৬৫ কোটি,২০০৮ সালে ৫৪৭৪০ কোটি, এভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১৫ সালে এসে তা হয়েছে ৯৮,৫১৫ কোটি টাকা।আর গত সাত বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার। যা টাকার অংকে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা বাংলাদেশের প্রায় এক বছরের বাজেটের সমান। অন্যদিকে জিএফআইয়ের গত মার্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার অর্থাৎ ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়।এভাবেই আমাদের মত দেশের মানুষের কষ্টার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়।এই যে প্রবণতা,এটি আমাদের মত গরীব দেশের জন্য একটি অশনিসংকেত।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হলেও এখন পর্যন্ত সরকার এর থেকে এক টাকাও উদ্ধার করতে পারে নেই।
প্রশ্ন হলো মানুষ কেন টাকা জমায়? ১. বৃদ্ধ অবস্থায় যেন অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে না পড়েন। ২. কোন বিপদ আপদে বা অসুখ বিসুখে যেন কারো কাছে হাত পাততে না হয় সেই জন্য। ৩. পরিবারের বা সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য।
তাই সক্ষম অবস্থায় যত বেশি পারে টাকা আয় করে। যা পরবর্তীকালে তারা ভোগ করে। যদি আমাদের দেশে বয়স্ক ও বৃদ্ধদের জন্য তাদের নিরাপদ আশ্রয়, অন্ন, চিকিৎসা ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতো। টাকা পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া গেলে ও বিদেশে পাচারকৃত টাকা দেশে ফেরত আনা গেলেই বিদেশে টাকা পাচার ও অবৈধ আয় অনেক কমে যাবে নিঃসন্দেহে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সংগঠক আশীষ বড়ুয়া
পরবর্তী নিবন্ধকোভিড-১৯ : ইতিহাসের ভয়াল বাঁকে পৃথিবী