পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত তিন দশকে কয়েকটি বিদেশী কোম্পানির সফল বিনিয়োগ হয়েছে। এ সময় দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ধাবিত হলেও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিবেশে বড় ধরনের কোনো উন্নতি হয়নি। কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া কাউকেই তেমন আকৃষ্ট করা যায়নি। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানির সফলতা দেখা গেলেও এগুলো বেশ নিরাপদ পরিবেশে এসেছে। তাদের জন্য নীতিগুলো বেশ সহায়ক ছিল। ফলে তারা যেভাবে মুনাফা করতে পেরেছে তা অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগের জন্য অসাধারণ এক বাজার বাংলাদেশ। তার পরও দেশে বড় আকারে বিনিয়োগ আকৃষ্ট না হওয়ার কারণ অভ্যন্তরীণ। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ নীতির ধারাবাহিকতার অভাব অর্থাৎ বছর বছর বিনিয়োগ নীতির পরিবর্তন, বিনিয়োগে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো এখনো কোনো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরে সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই)। আশির দশক–পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম, চীন, মেঙিকো ও ভারতের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমপ্রসারণে অবদান রেখেছে এফডিআই। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে এফডিআই। স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে চাইলে যেসব সমস্যা রয়েছে তা সমাধান করতে হবে। তাছাড়া এফডিআই আকর্ষণ করতে সবার আগে প্রয়োজন দেশের ব্র্যান্ডিং। বিনিয়োগবান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তোলার পাশাপাশি ব্যবসার জন্য আগে থেকে অনুধাবনযোগ্য একটি স্থিতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সিংয়ের অধিকার প্রয়োগেরও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে সরকারকেও সততার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির মিশন ডিরেক্টর রিড জে অ্যাচিলম্যান বলেছিলেন, ব্যবসা–বাণিজ্যে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও জ্বালানির মতো খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বড় বাধা দুর্নীতি। সেবা পেতে বেশি দুর্নীতি হয়। কিন্তু প্রতিযোগী দেশ হিসাবে এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ভিয়েতনাম। দুর্নীতি রোধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনসচেতনতা সৃষ্টি জরুরি। অ্যাচিলম্যান বলেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনা বিশাল। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেসরকারি খাতকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, সম্ভাবনার তুলনায় দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ব্যবসা–বাণিজ্য পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সেবা পেতে দুর্নীতির শিকার হতে হয়। এ কারণেই এ দেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা শতভাগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, জ্বালানির মতো বেশ কিছু খাতে এফডিআই বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজ অবস্থান করে নিয়েছে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিশেষ ইউটিলিটি সার্ভিস দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিনিয়োগ বান্ধব আইন বা নীতিমালা করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি অবকাঠামোর বিস্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন সেবা–পরিসেবা প্রদানে ওয়ান–স্টপ সার্ভিসও চালু করা হয়েছে। এ অবস্থায় দুর্নীতি দূরীকরণের বিষয়টি গুরুত্ব বহন করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য গত বছর শুরু হয়েছিল অস্থিতিশীলতায়। কোভিড–পরবর্তী পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে জ্বালানি পণ্যের বাজারদর ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যেই গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি করে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাত। এ আলোড়নের আঘাত এসে পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। এরই প্রভাব পড়েছে বিদেশী বিনিয়োগের ওপরও। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রকাশিত বিনিয়োগের পরিবেশ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সীমিত অর্থায়নের সুযোগের মতো বেশ কিছু কারণ বড় বাধা সৃষ্টি করছে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আধুনিক বিশ্বে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু শঙ্কাও কাজ করছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার অন্যতম ছিল দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এসব প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই দূর করতে হবে।