অতি সম্প্রতি অর্থনীতি বিষয়ে একজনের মন্তব্য পড়লাম। তিনি বললেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কেউ জানতে চাইলে ইংরেজির তিনটি অক্ষর বলি। ই এফ এবং জি। ই মানে এক্সপেট্রিয়েট ওয়ার্কার বা প্রবাসী শ্রমিক। এফ মানে ফার্মারস বা কৃষক। আর জি মানে গার্মেন্টস ওয়ার্কার বা পোশাক শ্রমিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত আসলে এই তিন খাত। এর মধ্যে প্রবাসী আয়ে তো নিত্যনতুন রেকর্ড হচ্ছে। এমনকি বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রীতিমত বিস্ময়কর।
বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা অর্থের বড় অংশটি আসে রেমিট্যান্স খাতে, অর্থাৎ প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে- যার আবার একটি বড় পরিমাণ পাঠান বিদেশে কাজ করা অদক্ষ কর্মীরা। পুরো বছরে প্রবাসীরা হাজার কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠান। কিন্তু যে প্রবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করে অর্জিত অর্থ দেশে পাঠান, তাদের অনেকেই দেশে ফিরে স্বজনদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হন। ওই অর্থ যাদের কাছে পাঠানো হয়, তারা নানা কারণে টাকা খরচ করে ফেলেন, আবার অনেক প্রবাসীর পাঠানো অর্থে গড়া সম্পদ শেষ পর্যন্ত অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়।
গত ১ মে দৈনিক আজাদীতে ‘বিদেশফেরত ৪৭% এরই কাজ জোটেনি’ শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বছর গড়ালেও করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের প্রায় অর্ধেক এখনও আয়ের কোনো পথ করতে পারেননি বলে উঠে এসেছে ব্র্যাকের এক গবেষণায়। গত শুক্রবার প্রকাশিত এই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশফেরতদের মধ্যে ৪৭ শতাংশের কপালে কোনো কাজ জোটেনি বলে দৈনন্দিন খরচ চালাতে ধার-দেনার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ৫৩ শতাংশ কৃষিকাজ, ছোটখোটো ব্যবসা বা শ্রমিক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করে বর্তমানে পরিবার চালাচ্ছেন বলে গবেষণায় দেখা যায়। তবে সব মিলিয়ে বিদেশ ফেরতদের ৯৮ শতাংশ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি ‘বিদেশফেরতদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অন্বেষণ এবং বিশ্লেষণ’ শীর্ষক ওই জরিপ পরিচালনা করে। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে জরিপের প্রতিবেদন তুলে ধরেন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর ফেরত আসা প্রবাসীদের নিয়ে গত বছরের ২২ মে একটি জরিপ প্রকাশ করেছিল ব্র্যাক। এক বছর পর পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা জানতেই ফের জরিপ করা হয়। গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় পদ্ধতিতেই দেশের সাতটি বিভাগের অভিবাসনপ্রবণ ৩০ জেলায় এই বছরের মার্চ ও এপ্রিলে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। গত বছর যাদের সঙ্গে কথা বলেছিল ব্র্যাক, তারাসহ এবার মোট ১৩৬০ জন বিদেশ ফেরতদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে ব্র্যাক।
বিদেশফেরত এই বাংলাদেশিরা এখন আছেন নানা সংকটে। সরকার অবশ্য বলছে, দেশে তাদের আর্থসামাজিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে ফেরত আসা প্রত্যাগত শ্রমিক বা তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ চার শতাংশ সুদে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। তবে নানা জটিলতায় এই তহবিল থেকে প্রবাসী কর্মীরা খুব বেশি সহায়তা পাচ্ছেন না।
অবশ্য ঋণ নিয়ে প্রবাসীরা আসলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না, তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে তাদের টেকসই পুনরেকত্রীকরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়া যায়। ফেরত আসা দক্ষ লোকজনকে দেশের ভেতরেই চাকরি দেওয়া যায়।
এতকিছুর পরেও কোটি লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান কিংবা প্রবাসী আয়ের রেকর্ডের খবরটা নিশ্চয়ই ইতিবাচক। সরকারি-বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতিবছর যে প্রবাসী আয় আসছে, সেটি মোট জাতীয় আয়ের প্রায় দশ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। তবে শুধু কর্মী পাঠানোর সংখ্যা না বাড়িয়ে দক্ষতার দিকেই সবার এখন নজর দিতে হবে।