প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশই পাঠান মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ওমানে বসবাসরত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা এই তালিকায় এগিয়ে রয়েছেন। এছাড়া কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ আরব দেশগুলোতেও বাংলাদেশি কর্মীর ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। তাদের আয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি। আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ঝুঁকিপূর্ণ রিজার্ভের বিপরীতে আশা জাগিয়েছে। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অধিকাংশই সাধারণ কর্মী। যাদের গড় বেতন বিশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা।
স্বাধীনতার পর থেকে শ্রম বিক্রি করতে বাংলাদেশিরা মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। ৫৩ বছর ধরে এই যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। প্রচার আছে, বাংলাদেশি কর্মীরা অন্যদের তুলনায় কম বেতনে চাকরি করেন। পেছনের গল্প ভিন্ন। কর্মীর বেতন বিবেচনা হয় দক্ষতার উপর। ভাষাগত দক্ষতা ও কর্ম দক্ষতা। গেল কিছু বছর ধরে এই বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। যেকারণে সরকারি সফরে আসা দেশের অতিথি ও দায়িত্বশীলরা বরাবরই ‘দক্ষ শ্রমিক নিতে চায় আমিরাত’ বলে বিবৃতি দিয়েছেন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সব দেশই এখন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি। এসময়ে এসে সর্বত্রই তাই দক্ষ শ্রমিক চাহিদা পরিলক্ষিত। তবে অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষদেরও প্রয়োজন আছে; যদিও তা পরিমাণে কম। সবাই জোর দিচ্ছে কর্মীর দক্ষতার উপর। বর্তমানে নতুন করে যোগ হয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতা। প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে আমাদের এমন কর্মী প্রেরণের প্রস্তুতি ঠিক কতটুকু? –এই প্রশ্ন এখনই করার সময়।
সম্প্রতি আরব আমিরাতে একজন বাগানকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি মাত্র ছয়শ দিরহাম বেতন পান। বাংলাদেশি মুদ্রায় ঊনিশ হাজার টাকার কাছাকাছি। দুবাইয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করা আরেক বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় হলো; তিনি পান বাইশ হাজার টাকা। এর মধ্য থেকে খাবার, মোবাইল বিল ও আনুষঙ্গিক খরচ করতে হয় তাদের। উন্নত জীবনব্যবস্থার একটি দেশে বসবাস করতে গিয়ে খরচের খাত বাদ দিলে ঠিক কত টাকা তাদের পকেটে অবশিষ্ট থাকে? সর্বোচ্চ পনের হাজার! দেশের দ্রব্যমূল্য ও টাকার মান হিসাব করলে এই অঙ্ক একেবারেই ছোট। অথচ এঁরা দেশটিতে আসার আগেই একেকজন অভিবাসন ব্যয় বাবদ খরচ করেছেন প্রায় তিন লাখ টাকা। দেখা যাবে– ওই টাকা তুলতেই তাদের শ্রম দিতে হবে প্রায় দেড় বছর।
যেদেশের কর্মী যত দক্ষ; সেদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাও তত বেশি। কেননা দক্ষকর্মী প্রেরণ করা গেলে অন্যদের সঙ্গে বেতন তারতম্যে তারা এগিয়ে থাকবেন– এই সহজ অংক সবাই বুঝেন। বুঝেন বলেই পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালও এখন মধ্যপ্রাচ্যে প্রশিক্ষিত কর্মী প্রেরণ করছে। প্রশিক্ষণের কথা ধরলে শুরুতে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও চীনের কথা বলতে হবে। আফ্রিকার দেশগুলোও এখন ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের বিদেশে প্রেরণ করছে। ভারত ব্যবসার দিক থেকে অনেকের চেয়ে এগিয়ে। আর বাংলাদেশ এখনো দ্বারে দ্বারে ঘুরছে– অদক্ষ ও স্বল্প শিক্ষিত কর্মী প্রেরণের তালিকা নিয়ে। মুখে মুখে প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও বিদেশে প্রেরণের পূর্বে আদতে দেশে তেমন প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না কর্মীরা। এমনকি মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত প্রচারণাও নেই বললে চলে। মধ্যপ্রাচ্যে পা রাখা অধিকাংশ কর্মী কোন না কোনভাবে নিকট মানুষজন ধরেই আসেন। সেক্ষেত্রে তাদের প্রশিক্ষণের মাত্রা ‘শূন্য’ বলা যায়। না ভাষা জ্ঞান, না কর্ম দক্ষতা। আবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করা কর্মীরাও কোন রকম বিএমইটি’র কার্ড সংগ্রহের জন্য কয়েক দিন নির্দিষ্ট অফিসে যাতায়াত করেই দিন পার করেন। যদিও এদের প্রশিক্ষিত কর্মী হিসেবেই পরবর্তীতে গণনা করা হয়। তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো তথ্য বলছে, ২০২০ সালে বিএমইটির আওতায় পরিচালিত আইএমটি ও টিটিসি সমূহে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রশিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫১১ জন। কাগজের কলমে এই হিসাব থাকলেও এরমধ্যে বাস্তবিক প্রশিক্ষিত কর্মী আদতে কতজন –তা বলা মুশকিল।
রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যেহেতু দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। তাই এদের নিয়ে বিস্তর ভাবা উচিত। বিদেশে কর্মী প্রেরণের আগে প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ করে গড়ে তোলা উচিত। কারিগরি জ্ঞানের পাশাপাশি কর্মী কোন কাজে বিদেশে যাবেন ঠিক ওই কাজের উপর তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাও হাতে–কলমে। সাথে ভাষা জ্ঞানেও সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। কারণ বাস্তবিক প্রশিক্ষণ কেবল কর্মীদের এগিয়ে দিবে তা নয়; তুলনামূলক বাড়াবে বৈদেশিক মুদ্রা। উদাহরণ টানছি– ফিলিপাইনের একজন প্রশিক্ষিত কর্মী বেতন পান ২ হাজার দিরহাম। আবার ২ হাজার দিরহাম তুলতে চারজন বাংলাদেশি অদক্ষকর্মী কাজ করতে হচ্ছে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে। বিপরীতে প্রশিক্ষিত কর্মী এলে এখানে সমীকরণ বদলাবে। মানে চারজনের আয় আসবে একজনের হাত ধরে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা তাকে বাকিদের থেকেও এগিয়ে রাখবে। এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রকেই নিতে হবে– আরো অদক্ষ কর্মী প্রেরণে উৎসাহী হবে; নাকি দ্রুতই প্রশিক্ষিত কর্মী প্রেরণের দিকে বেশি জোর দিবে।
একজন প্রবাসী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি– আগামী দিনগুলোতে যেই দেশ যত বেশি দক্ষ কর্মী দিতে পারবে, বৈশ্বিক শ্রমবাজারে সেই দেশ ততবেশি এগিয়ে থাকবে। তাই বাংলাদেশকেও প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। জোর দিতে হবে কর্মীর কারিগরি শিক্ষায়, ভাষায়। প্রতিযোগিতার মাঠে প্রতিযোগীর ভূমিকার অবতীর্ণ হতে হবে। এখন থেকে অদক্ষ কর্মীর বিপরীতে দক্ষ কর্মী প্রেরণের গড় হার বাড়াতে হবে। সেই দক্ষ কর্মী হতে হবে বাস্তবিক প্রশিক্ষিত। যিনি বিদেশের মাটিতে হয়ে ওঠবেন বাংলাদেশের একজন প্রকৃত প্রতিনিধি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, সংযুক্ত আরব আমিরাত।