বিজয় নিশান উড়ছে ঐ

রেজাউল করিম | বুধবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক জীবন এবং ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে বাঙালির শৌর্যবীর্য যেন আর একবার জ্বলে উঠে। বাঙালিদের ওপর যখন উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্ত শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী, তখন বসে থাকেনি বাঙালি। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া সেই আন্দোলন জ্বলে উঠে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার সবখানে। চট্টগ্রামে বসে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন-‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’ যেটি একুশের প্রথম কবিতা। ছাপা হয়েছিল কোহিনুর প্রেসে। ভাষার জন্য আর কোনো জাতি জীবন দেয়নি। অবাক চোখে তাকিয়ে রয় বিশ্ববাসী।

সেই থেকে শুরু হয়ে যায় বাঙালির শেকল ভাঙার লড়াই। পাকিস্তানিদের সঙ্গে হিসেবনিকেশের হালখাতার শুরুতেই রক্তের আঁচড় দিয়ে বাঙালি শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়/ আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো/ দানবের মতো চিৎকার করতে করতে/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল/ আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র’। (তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা : শামসুর রহমান)

পূর্ব দিগন্তে উদিত যে সূর্য, প্রতিদিনের হয়েও সে প্রতিদিনের নয়, তার রক্তিমতায় লাখ লাখ শহীদের রক্ত। একাত্তরের সম্ভ্রমহারা দশ লাখ মাবোনজায়ার ক্রন্দন ধোয়া সেউদ্ভাস। সাগরসম রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্তসাগর পেরিয়ে বাঙালি জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জনের ইতিহাস শুধু ১৯৭১ সালে সীমাবদ্ধ নয়। ইস্পাতকঠিন ঐক্যে দৃঢ় জাতির দীর্ঘ সংগ্রাম আর ত্যাগের সুমহান ফসল এ বিজয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী আঘাত করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর। শুরু হয়ে যায় শোষণবঞ্চনা আর বৈষম্যের করুণ ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সে শোষণ থেকে মুক্তি পেতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির জাতীয় চেতনার প্রথম স্ফুরণ ছিল ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় জিন্নাহর এমন ঘোষণার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে, যা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পায় রক্তাক্ত পরিণতি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে বাঙালির বিজয় এবং তা কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এসব সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা তথা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৬৯এ গণতন্ত্র ও জাতীয় অধিকারের জন্য গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০এ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়।

এই বিজয় পাকিস্তানি শাসক চক্র প্রত্যাখ্যান করলে ১৯৭১এর ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। ঘনিয়ে আসে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার স্পৃহায় জেগে উঠেছিল গোটা জাতি। কিন্তু বাঙালিকে স্তব্ধ করতে ২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। সেই গণহত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা।

শুরু হয় হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত প্রতিরোধ লড়াইমুক্তিযুদ্ধ। নয় মাস ধরে চলা সে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের কলঙ্কিত অধ্যায়ের বিপরীতে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের আরেকটি মহান অধ্যায়। সে অধ্যায়ে ছিল মুক্তিকামী বাঙালির অসম সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের বীরত্বগাথা।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে ঘনিয়ে আসে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন হানাদার সেনা। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় লালসবুজের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং মানচিত্র।

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করলেও মুক্তির স্বাদ পায়নি ৫৩ বছরেও। অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত স্বাধীনতার স্বাদ অপূর্ণ থেকে যায়। এখন বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের কাজ চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরঞ্জিত আমি চেতনার রঙে
পরবর্তী নিবন্ধআঞ্জুমানে খোদ্দামুল মুসলেমীনের