পাকিস্তান আমলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সফিনায়ে হুজ্জাজ ও শফিনায়ে আরাফাত নামে জাহাজে অধিকাংশ হাজীগণ হজ্বে যেতেন। বিমানে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা প্রথম পর্যায়ে ছিল খুব স্বল্প। পরের দিকে তা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ সময়ে এক বছর সফিনায়ে হুজ্জাজ চট্টগ্রাম থেকে পূর্ব পাকিস্তানী হাজীদের নিয়ে করাচি বন্দরে পৌঁছে সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হাজীদের জাহাজে উঠার ব্যবস্থা করেন। সে বছর পশ্চিম পাকিস্তানের হাজীদের মধ্যে ছিলেন-সিন্ধু প্রদেশের লারকানা নিবাসী হাফেজ হযরত শাহ ছুফি মওলানা আবুল কাশেম মাসুরী (রাহঃ) নামে একজন প্রসিদ্ধ পীর সাহেব সিন্ধু প্রদেশ ও পাকিস্তানের অন্যত্র তাঁর মুরীদ ছিল প্রায় তিন লক্ষের কাছাকাছি। তিনি তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে ছোটজনকে এবং তার কিছু মুরীদানদের সাথে নিয়ে হজ্বে গমন করেছেন। তাঁর সেবারের সফরের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তিনি ছিলেন খুব শান্তশিষ্ট তবিয়তের মানুষ। তাঁর প্রথম সন্তানটিও ছিল তাঁর মত। কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় সন্তানটি ছিল দুরন্ত পরায়ণ, চঞ্চল ও দুষ্টু প্রকৃতির। একজন প্রসিদ্ধ শেখ-এ তরিকতের সন্তান হিসাবে সেটা ছিল বেমানান এবং শ্রদ্ধেয় পিতার জন্য লজ্জাকর। তিনি নিজস্ব প্রকৃতিতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন তাকে বাগে আনতে, কিন্তু সব কিছু ব্যর্থ হয়েছে। অতঃপর তিনি স্থির করলেন যে, হজ্বের সময়ে পবিত্র হেরেমাহন শরীফাইনে বহু আল্লাহর মকবুল বান্দা তশরিফ আনেন। তাদের মধ্যে কোনো একজনকে দিয়ে ছেলেটার জন্য দোয়া করালে হয়ত সে দুরস্ত হয়ে যাবে।
জাহাজ জেদ্দা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার একদিন পর পীর সাহেব তাঁর কামরা থেকে তাঁর সাধারণ মুরীদদের অবস্থা জানতে ডেকে গেছেন, হঠাৎ এ সময়ে একজন সুন্দর সুপুরুষ আলেমের পোশাকধারী ব্যক্তি এসে পীর সাহেবকে প্রশ্ন করলেন-আপনি হাফেজ আবুল কাশেম মাসূরী? আপনার বাড়ি সিন্ধের লারকানায়? আপনার বাড়ির সামনে একটি অমুক গাছ আছে না? ঘর পূর্ব দরজা না? পীর সাহেব প্রতি কথার হাঁ সূচক জওয়াব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি শুধু পূর্ব পাকিস্তানে বলেই দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন। পীর সাহেব কিছুটা বিমোহিত হয়ে ধীরে ধীরে তাঁর কামরায় চলে আসলেন। তারপর ভাবতে লাগলেন এ মানুষটির বাড়ি পূর্ব পাকিস্তানে, আর ইনি আমার এতসব পরিচয় জানলেন কেমনে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হলো, তা হলে ইনিই কি সে মহান ব্যক্তি যার খোঁজে আমি আল্লাহ ও রসূলের দরবারে হাজিরা দিতে যাচ্ছি। অতঃপর পীর সাহেব সে আগন্তুককে সারা জাহাজ খোঁজলেন কিন্তু জিদ্দা পৌঁছা পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পেলেন না। জাহাজ থেকে অবতরণ করে পীর সাহেব প্রথমে মদীনায়ে মনোয়ারায় জেয়ারত করলেন। আট দিন পরে মক্কায়ে মোয়াজ্জমায় হাজিরা দিতে আসলেন। উভয়স্থানে তার বেশ কিছু ভক্ত রয়েছে। মক্কা শরীফে এসে তিনি তার এক ভক্ত মুরীদের গৃহে উঠলেন। উঠেই ঐ রাতে তাহাজ্জুদের পরে মোরাকাবা অবস্থায় অবগত হইলেন-তুমি যার সন্ধানে এসেছ তিনি একজন বাঙালি হাজী, যিনি আজ থেকে ১৬ বছর আগে একবার হজ্বে গিয়ে মদীনা শরীফে যখন অবস্থান করছিলেন সে সময়ে এক গভীর রাত্রে কেউ তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় এবং সে অদৃশ্য শব্দটি তাঁকে বলে এখনই রওজা মোবারকে যাও, এটাই সে বিশেষ সময় যখন তোমার কামনা পূর্ণ হবে। তিনি দ্রুত গতিতে অজু করে মদীনার নির্জন রাস্তায় নেমে পড়লেন এবং রওজার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। সে সময়ে রাতে এশার নামাজের কিছু পরে রওজা মোবারকের দরজা বন্ধ হয়ে যেত এবং তাহাজ্জুদের সময়ের পূর্বে রওজার দরজা খোলা হতো না। তিনি রওজা মোবারকের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন একজন মানুষ তার পিঠে হাত দিয়ে তাকে গাইড করে নিয়ে যাচ্ছেন। রওজা মোবারকের সম্মুখে পৌঁছে ঐ অপরিচিত জন বললেন- এটাই রওজা তুমি ভিতরে গিয়ে হাত উঠাও তোমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু আপনি কে? তিনি জওয়াব দিলেন-‘আমি রওজা ওয়ালা’ তিনি চমকে উঠলেন, কিন্তু ততক্ষণে অপরিচিত জন অদৃশ্য হয়ে গেছেন। ঐ ব্যক্তি অবাক হয়ে দেখলেন ঐ নিষিদ্ধ সময়ে রওজা মোবারকের দরজা উন্মুক্ত এবং রওজা আলোকিত। তিনি দ্রুত রওজা শরীফে প্রবেশ করলেন এবং হাত তোলে তাঁর সকল কামনার কথা রহমানুর রহিমের দরবারে পেশ করলেন। ১৬ বছর পূর্বে যিনি নবী করিম (সঃ) কাছে এত প্রিয় ছিলেন সে সম্মানিত কামেল ব্যক্তি এখন কাবা শরীফের মোলতাজিমের গোড়ায় উপবিষ্ট আছেন। তুমি এখনই তোমার পুত্রকে নিয়ে সেখানে যাও আর তোমার আবেদন তাঁর কাছে পেশ করো। পীর সাহেব দ্রুত মোরাকাবা সমাপ্ত করে তাঁর পুত্রকে নিয়ে কাবা শরীফের দিকে রওয়ানা হলেন এবং দেখলেন সত্যি সত্যি একজন মানুষ উল্লেখিত স্থানে এবাদতে মগ্ন আছেন।
পীর সাহেব বা-আদব তাঁর পুত্রকে নিয়ে উক্ত বুজুর্গ ব্যক্তির পেছনে নীরবে উপবেশন করলেন। উক্ত সম্মানিত জন তার নিমগ্ন ভাব ত্যাগ করে একটু নড়ে বসলেন, তখন পীর সাহেব অতি আদবের সাথে পেছন হতে আস্তে করে বলে উঠলেন -‘হুজুর’ তিনি কিছুটা তিক্ষ্ণ কণ্ঠে পেছন ফিরে বলে উঠলেন ‘কোন হে কেয়া মাঙতা’। তিনি সাথে সাথে হাত জোড় করে বললেন ‘হুজুর মেরা পর হুকুম হুয়া আপকা পাছ আনে কেলিয়ে। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন ‘লেড়কা কাহা’?, ‘ছাত লায়াহো হুজুর’- পীর সাহেব জওয়াব দিলেন। তিনি পীর সাহবকে ইশারায় জানালেন তাঁর পুত্রকে উনার পাশে বসাতে। তিনি তাই করলেন। অতঃপর তিনি পীর সাহেবকে বললেন- ইয়ে আল্লাহকা ঘর, আপভি আল্লাহকে বান্দা হে, মাইভি আল্লাহকা বান্দা হোঁ, মাই দোয়া করুঙ্গা আউর আপ দুনো আমীন আমীন কহো। তিনি দোয়া করলেন আর তারা পেছনে থেকে আমীন আমীন বললেন।
দোয়া শেষ করে তিনি বললেন-আজ থেকে তোমার এ সন্তানের ভার আমি নিলাম। তুমি এ সন্তানকে আর শাসন করবে না, আমি যেখানেই থাকি তাকে আমি শাসন করব। সন্তানের দুরন্তপনা শেষ হয় ঐ দিনই। তিনি কিভাবে চট্টগ্রাম থেকে সিন্ধুতে বসবাসরত পীর সাহেবের পুত্রকে শাসন করেছেন তা আমি শুনেছি এবং দেখেছি।
আর জন্মদাতা পিতা সৈয়দুল হুফফাজ হযরত শাহ সূফি মওলানা মীর মাসুদ আলী চিশতী নখশেবন্দি ছিলেন দেওবন্দ হতে শিক্ষা প্রাপ্ত প্রসিদ্ধ মোহাদ্দেস, ফকিহ, হাফেজ ও আলেম, তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রসিদ্ধ পীর মোর্শেদ কুতুবুল এরশাদ হযরত শাহ মওলানা মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিক (রাহঃ) এর খলিফা ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন মাদ্রাসায়ে দারুল উলুমের সম্মানিত শিক্ষক ছিলেন।
পিতৃসূত্রে তিনি আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট বড় পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রাহঃ) এর সাক্ষাৎ বংশধর, যার বিস্তারিত বর্ণনা তাঁর জীবনী গ্রন্থ মহিমাময় জীবন-এ বর্ণিত আছে। যে গ্রন্থ তাঁর জীবনের বিস্ময়কর কেরামতে পরিপূর্ণ। তিনি কুতুবুল আলম হযরত শাহ সূফি আলহাজ্ব মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতার (রাহঃ) যিনি নিজ অনুসারীগণের কাছে হযরত কেবলা নামে পরিচিত। তাঁর মুখে প্রথম কথা ফুটে আল্লাহ, শিশুকালেই তিনি দোলনায় কারো শিখিয়ে দেয়া ছাড়া আপনা আপনি আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতেন, জিকির করতে করতে বেহুশ হয়ে যেতেন। দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে সসম্মানে ফাজিল পাশ করে তিনি হাদীস শিক্ষার জন্য দেওবন্দ আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে হোস্টেলে অবস্থানকালে স্বপ্ন যোগে ছরকারে দো জাহান নবী করিম (সঃ) স্বপ্ন যোগে আদিষ্ট হন সোলতানুল হিন্দ হযরত খাজা গরীব নওয়াজের দরবারে হাজির হয়ে একজন বিশেষ মহান ব্যক্তির হাতে বায়াত হতে। তিন বার পর পর এ নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি তার ওস্তাদ প্রসিদ্ধ মোহাদ্দেস মুফতি শফি সাহেবের পরামর্শে মাদ্রাসা থেকে ছুটি নিয়ে আজমিরে খাজা বাবার দরবারে হাজির হন। পৌঁছার পরের দিনই দরবারের শাহজাহান মসজিদে তাঁর দেখা পান। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন- তোমার নাম মীর মোহাম্মদ আখতার না? তিনি জওয়াব দিলেন ‘জি’, আমি দেওবন্দ থেকে এসেছি। অতঃপর পীর মোর্শেদের নির্দেশে প্রতি বছর খাজা বাবার দরবারে তিনি হাজিরা দিতে থাকেন এবং প্রতিবারে পীর মোর্শেদের তোয়াজ্জ্বের বরকতে তার আধ্যাত্মিক সম্পদ সমৃদ্ধতর হতে থাকে। অবশেষে মহান শেখের জীবনের শেষ সফরে তিনি তাঁকে তরিকতে আলীয়ায়ে কাদেরীয়ার তাঁর আয়ত্তের শেষ ছবক দান করেন এবং নির্দেশ দেন-তোমার সাথে আমার আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যে সম্পদ আমি আল্লাহর তরফ থেকে আমার পীর মোর্শেদের মাধ্যমে লাভ করেছিলাম তা আজ আমি তোমাকে অর্পন করে গেলাম। আমার আজীবন অনুসৃত তরিকত-খালেছ তরিকায়ে আলীয়ায়ে কাদেরিয়ার প্রচার ও প্রসারের দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম।
মহান পীর মোর্শেদের অর্পিত দায়িত্ব তার সার্থক উত্তরাধিকারী কত বিস্ময়কর ভাবে বাস্তবায়িত করেছেন, বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে প্রায় ৭০০টি আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও জনহীতকর প্রতিষ্ঠান, খানকা ও মসজিদ সমূহ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
তাঁর দ্বীন ও তরিকতের প্রচার ও প্রসার কর্মসূচিতে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন এলম ও আমলের উপর। তাই তাঁর তরিকতের পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ (খলিফা) সকলেই ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও আবেদ। ১৯৭১ সালের আকবরি হজ্বের পর পবিত্র মিনা হসপিটালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে জান্নাতবাসী হন। তার জান্নাতবাসী হওয়ার অর্ধশতাব্দি যাপিত হওয়ার পরেও তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বে এখনও তাঁর প্রতিষ্ঠিত দরবারে তওহীদ ও সুন্নতের সকল কানুনকে সম্মুখে রেখে তরিকায়ে আলীয়ায়ে কাদেরীয়ার পবিত্র কর্মসূচি সমূহ পরিচালিত ও পালিত হচ্ছে।
লেখক: সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ। এডভাইজার, মাসিক দ্বীন দুনিয়া