অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ৩ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকার এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ বাজেট ঘোষণা করেছেন। এটি ৫০তম বাজেট। এর আয় দেখানো হয়েছে ৩,৮৯,০০০ কোটি টাকা। ঘাটতি ২,১৪,৬৮১ কোটি টাকা। এই বাজেটে বিদেশি অনুদান ০.৬%, ঋণ ১৬.২%, অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৮.৮%, কর ছাড়া প্রাপ্তি ৭.১%, এনবিআর বহির্ভূত কর ১৬%, নিয়ন্ত্রিত কর ৫৪%। বিদ্যুৎসহ চট্টগ্রামের ৪৩ প্রকল্পে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের জন্য সাধুবাদ জানাই।
অর্থমন্ত্রী নিজে ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসা বান্ধব বাজেট দিয়েছেন। তার মতে অতিমারী ও বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে একটি করহার নির্ধারণ সময়ের দাবি। বাজেটে পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানির করহার ২৫% এর স্থলে ২২.৫% প্রস্তাব করা হয়েছে। চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুল আলম দেশীয় শিল্পে প্রণোদনা দেয়ায় অর্থনীতি বেগবান হবে বলে বলেছেন। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ব্যয় সবচেয়ে বেশি। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে আমদানী পর্যায়ে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালের অগ্রিম কর ৩% কমিয়ে ২%, ইস্পাত শিল্পে উৎসের কর ৩% কমিয়ে ২% করায় এই সেক্টর এবং এই সেক্টরের রপ্তানীকারকরা উপকৃত হবে। এর সাথে বিলেট রপ্তানীকারক ইস্পাত শিল্পকে ডিউটি ড্রব্যাক সুবিধা সহ ১৫% নগদ প্রণোদনা দেয়া দরকার।
এই বাজেটে দাম বাড়বে- মোবাইল, সিগারেট, বিদেশি মাংস, মাশরুম, গাজর, টমাটো, বিদেশি বিস্কুট, সাবান, মদ। দাম কমবে স্যানিটারি ন্যাপকিন, দেশি গৃহস্থালী সরঞ্জাম, ক্যানসারের ওষুধ, দেশি রাউটার হেড ফোন, শৌচাগারের প্যান ইত্যাদি।
ট্রেডবডি নেতা মো. জসিমউদ্দিন বলেছেন, ‘বাজেট অবাস্তব নয়।’ এ কে আজাদ বলেছেন, ‘করোনা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে।’ ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মীর নাসির মন্তব্য করেন, ‘কর পরিধি না বাড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে করদাতারা।’ ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেছেন, ‘সাহসী বাজেট।’ মেট্রোপলিটন সভাপতি খলিলুল রহমান এর অভিমত, ‘জনকল্যাণমুখী বাজেট।’ মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, ‘৭০ লাখ টার্নওভারে কর মওকুফ ইতিবাচক।’ অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অতিমারীর বাস্তবতা উঠে আসেনি।’ ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, ‘অতিমাত্রায় গতানুগতিক বাজেট।’ আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘স্বজনতোষী বাজেট।’
শুরুতে আমরা বলেছি এটি ‘ব্যবসাবান্ধব বাজেট।’ সাধারণ মানুষের তেমন লাভ হবে না। অতিমারীর সময়েও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ প্রতিবারের চাইতে কম। মূলত ১৯৯১ সালে ১৫% ভ্যাট প্রয়োগ অতিরিক্ত ছিল। তখন থাইল্যান্ডে ভ্যাট ছিল ৭%। ভ্যাটের রেয়াত সম্পর্কে সংশয় থাকবে। ভবিষ্যতে প্রণীতব্য কাস্টমস আইনে কী থাকছে নজর রাখতে হবে। তবে হাইব্রিড, বিদেশে টাকা পাচারকারী, ঋণ খেলাপী, পার্টিজান, এমনকি ৭১-এর বিপক্ষের শক্তির ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দেয়া উচিত কি না তা যাচাই বাছাই করতে হবে। কারণ, ‘তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে।’
আমরা নিউ নরমাল ইকনোমিতে অতিমারী ও আগামীতে সম্ভাব্য সকল রোগ বালাই রোধে একটি কঠোর স্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তুলতে চাই। আমরা প্রতিরক্ষার চাইতে অতিমারীর স্বাস্থ্যখাতকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ ৩২,৭৩১ কোটি টাকা। থোক বরাদ্দ ১০ হাজার কোটি টাকা। যা চলছি বছরের চাইতে বরাদ্দ ১২% বেশি। জাতীয় বাজেটের ৫.৪% মাত্র। এক্ষেত্রে ৮০% মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে ৪৬ ধরনের পণ্য আমদানীতে শুল্ক ও কর ছাড় দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম সহ কয়েকটি জেলায় গ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ বছরের কর দেয়া হয়েছে। তবে সেগুলো মুখ্যত অতিমারী সেবা ৯০% থাকা বাঞ্ছনীয়।
অতিমারীর সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগ্রোবেইসড ইকোনমি গড়ে তোলার জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি চাষাবাদ, প্রতি জলাশয়ের মৎস্য চাষের মধ্যে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। আমরা মনে করি, কৃষি খাত এখনও শক্তিশালী প্রাইভেট সেক্টর এবং এটি ক্রাউডেট সেক্টর নয়। তাই প্রতিটি গ্রামে ইউনিয়নে কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে শস্য ফলানো, তার ন্যায্য দাম দেয়া, প্রকিউরম্যান ও সাপ্লাই চেইনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে অতিমারী বা সংকঠের সময় কোনো ধরনের সমস্যা দেখা না দেয়।
অনলাইন ইকোনমি এখন একটি শক্তিশালী সেক্টর হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে গ্রোসারি শপের অনলাইনের উপর ভ্যাট প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্টরা দাবি জানিয়েছিল। এভাবে ই-কুরিয়ার, ফ্যাশন মার্কেটের বর্তমান বাজার ৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা দাঁড়াবে ১০ হাজার কোটি টাকা, খেলনা ও শখের পণ্য বাজার দাঁড়াবে ৪ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এইক্ষেত্রে ভ্যাট ও ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক না করার জন্য প্রস্তাব করেছে। কারণ এখানে ৫০ শতাংশ নারী ঘরে বসে ব্যবসা করছে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটকে পণ্য না ভেবে কাঁচামাল হিসেবে গণ্য করে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে। তবে ই-কমার্সে একটি নজরদারি না থাকলে, গ্রাহকগণ প্রতারিত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
কটেজ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিভিন্ন সময় প্রণোদনা দেয়া হয়ে থাকে। এরজন্য একটি এসএমএসই ফাউন্ডেশন রয়েছে। কিন্তু ঋণ পেতে ব্যাংকে দালিলিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঋণ পাওয়া যায় না। যার ফলে এক্ষেত্রে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখা উচিৎ।
কালো টাকা জরিমানা দিয়ে বৈধ করা যাবে, এতে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেল। তাছাড়া এক নজরে বলা যায়, আয় কমলেও ছাড় নেই, শিক্ষার ব্যয় বাড়তে পারে। সঞ্চয়পত্র ও বাড়ির নকশায় টিন এটা অযৌক্তিক। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বেড়েছে, প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা চলবে, অতিধনীদের সারচার্জ বাড়বে। পোশাক শিল্পে ১% অতিরিক্ত প্রণোদনা পাবেন। চিকিৎসা গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এগুলো সব ইতিবাচক দিক। ইনফরমাল সেক্টরসমূহকে গণনায় আনা হয়নি। অতিমারীর আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ২ কোটি ৪৪ লক্ষ, অতিমারীর কারণে কর্মহীন হয়েছে ১ কোটি ৪৪ লক্ষ। অবহেলিত রয়ে গেছে কৃষি ও মৎস্যখাত। এদের কর্মসংস্থান বা খাদ্য নিরাপত্তার কী হবে? সর্বশেষে আমরা বলি এই বাজেট চ্যালেঞ্জিং। সামাজিক সুরক্ষা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।