দুই বছর হতে চলেছে বাবাহীন আমার। তবে যাপিত এই দিনগুলির মাঝে হৃদয়ের মনিকোটায় গভীর মমতায় আগলে রাখা অমূল্য স্মৃতির আকর আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে বহমান সময়ের সাথে, কেননা আমার বাবা প্রফেসর ডা. এল এ কাদেরী আপন আলোয় উদ্ভাসিত এক পরিপূর্ণ মানবাত্মা। প্রকৃতঅর্থেই বরেণ্য একজন মানবিক চিকিৎসক। পাঁচলাইশের ‘সোনার তরী’তে প্রবেশ করা মাত্র চোখে পড়বে আলমারীতে থরে থরে সাজানো বাবার অগুণিত পদকের সম্ভার যা বহন করে চলেছে বাবার কীর্তিগাথা।
পেশাগত উৎকর্ষে পাশাপাশি নিরলস সমাজসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। আজ পার্থিব অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মানুষের হৃদয়ের চিরন্তন স্থানে অধিষ্ঠিত আছেন, থাকবেন আমার বাবা।
শৈশবে কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময়েই শিশুমন বুঝে ফেলেছিলো আমার বাবা একজন ‘রিয়েল লাইফ হিরো’। একদিন ভোরে স্কুলে আমাদের নামিয়ে বাবা গাড়ি স্টার্ট করার সময় অবাক হয়ে দেখলাম আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম, টিচার এবং প্রহরী সবাই বাবার গাড়ির কাছে ছুটে আসছেন, ইশারা করে থামানোর চেষ্টা করছেন একযোগে। বাবা গাড়ি থেকে বের হতেই জানা গেলো একটি বাচ্চা খেলতে গিয়ে পড়ে আহত হয়েছে। বাবার সাথে আমরা স্কুলের খেলার মাঠে গিয়ে আবিষ্কার করলাম বাচ্চাটার মাথা ফেটে সারা শরীরে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এই দৃশ্য আমাদের সবার মধ্যে চরম আতংকের সৃষ্টি করলেও বাবা তাৎক্ষণিকভাবে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করাতে সবার মনে স্বস্তি ফিরে এলো। বাবার এই তৎপর পদক্ষেপে বাচ্চাটি অল্প সময়ের মধ্যে সুস্থ হয়ে স্কুলে ফিরে এসেছিলো। মনে আছে ছোটবেলায় একবার দেশের অনেকগুলো সংবাদপত্রে বাবার খবর প্রকাশিত হয়েছিলো ‘দীপালী বড়ুয়া’ নামে একজন রোগীকে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কৃত্রিমভাবে শ্বাস প্রশ্বাসের (সিপিআর) ব্যবস্থা করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার অলৌকিক প্রচেষ্টার কথা। স্বভাবজাতভাবে প্রচারবিমুখ বাবার জন্য তা কিছুটা বিব্রত হবাব মতন ব্যাপার ছিলো, তাই কখনো পেপার কেটে খবরটা সংগ্রহ করার কথাও ভাবেননি।
দিন–রাত বাবাকে অনলস পরিশ্রম করতে দেখেছি তাঁর প্রাণপ্রিয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ নিউরোসার্জারী বিভাগ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে তরুণ চিকিৎসকদের হাতে কলমে তালিম দেওয়ার। আজ তাঁদের অনেকেই মানবসেবায় ব্রতী হয়ে বাবার জ্বেলে যাওয়া প্রদীপটি বহন করে চলেছেন। আমরা দুই ভাই বোন বাবার পেশা অনুসরণ না করার কারণে বাবাকে এই প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছে, বাবা যার উত্তরে আমাদের স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন চিন্তাধারাকে অনুপ্রেরণা যোগানোর কথা বলতেন। তবে আজ এর উত্তরে আমার সত্যি বলতে ইচ্ছে হয়– বাবার হাতে গড়া ছাত্রছাত্রীরা এক্ষেত্রে তাঁর পুত্র কন্যাসম, নিজের সন্তানের সাফল্যে যেমন পিতা মাতা গর্ববোধ করেন, বাবাও ঠিক ওভাবেই তাঁর ছাত্র–ছাত্রীদের অর্জনে নির্মল আনন্দ পেয়েছেন, দেশ এবং জাতিকে উপহার দিয়েছেন নিজের হাতে গড়া নতুন প্রজন্মের অনেক নিউরো সার্জনদের তাই বাংলাদেশকে নিউরোসার্জারিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে বাবার অনন্য ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস করি। ছাত্র–ছাত্রীদের বাবা যে কতখানি স্নেহ করতেন তা দু একটি ঘটনার মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
খাতা কাটার সময় যেদিন বেশি ভুল বাবার চোখে পড়তো, সেদিনই খাবার টেবিলে খেয়াল করতাম বাবার মন খারাপ, অন্যদিকে যেদিন ভালো নম্বর দিতেন সেদিন খুব প্রফুল্ল মেজাজে থাকতেন। মার কাছ থেকে শোনা বাবা যখন নিজের পছন্দের সোনালি ফ্রেমের একটা চশমা পড়তেন তখন মা পরোক্ষভাবে জানতে পারেন এই চশমা দিয়ে তাকালে বাবাকে গুরুগম্ভীর লাগার কারণে ছাত্র–ছাত্রীর মনে কিছুটা ভীতির উদ্রেক হয়। বাবা জেনে যাওয়ার সাথে সাথে সেদিনই চশমার দোকানে গিয়ে ফ্রেম বদলে ফেলেছিলেন। বাবাকে এরপর আর সোনালি ফ্রেমের চশমা পড়তে দেখিনি। এখন ভাবলে বিস্মিতবোধ করি কতটুকু বন্ধুভাবাপন্ন হলে বাবা এমনটি করতে পারেন।
চিকিৎসক হিসেবে বাবার মতন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ বিরল, বাবার অজস্র স্মৃতি তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সাক্ষর বহন করে। ছোটকাল থেকে দেখে এসেছি অনেক কাছের মানুষের সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন–বিয়ে, বৌভাত ইত্যাদির আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি ইমার্জেন্সী রোগীর জীবন রক্ষা করতে গিয়ে। এতে কেউ মন খারাপ করলে বাবা হেসে বলতেন-‘আগে বিয়ে করে ফেলেছি বলে রক্ষা, না হলে আজকে নিজের বিয়েও মিস করতাম’। ঈদের নামাজ শেষ হতেই কতবার সরাসরি বাবা ছুটে গিয়েছেন দুর্ঘটনায় পতিত রোগীর সেবা করতে। আরেকটি কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হলো আমার মা সার্বক্ষণিকভাবে বাবাকে সাহস, শক্তি এবং মনোবল যুগিয়ে এসেছেন, এক পরম ভরসার স্থল হয়ে বাবাকে একনিষ্ঠভাবে তাঁর পেশায় মনোনিবেশ করতে অপরিহার্য্য ভূমিকা পালন করে গেছেন সবসময়। তাই মানবসেবার মহান ব্রত অন্তরের অন্তঃস্থলে ধারণ করে সব পরিচয় ছাপিয়ে বিশেষ করে চট্টগ্রামবাসীদের কাছে বাবা হয়ে উঠেছিলেন ‘আঁরার ডাক্তর’।
শেষবার আমেরিকায় ভ্রমণের সময় প্লেনে যখন এক সহযাত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো তখন তাৎক্ষণিকভাবে বাবার সহায়তা ও চিকিৎসার কারণে সুস্থভাবে গন্তব্যে তাঁর পৌঁছানোর ঘটনাটি শুনে আমার ছোটবেলার সেই ‘রিয়েল লাইফ হিরো’কে আবার নতুন করে আবিষ্কার করলাম। এমন অসংখ্য স্মৃতি ক্ষণে ক্ষণে দোলা দেয় মনের গহীনে।
শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্র বলে নয়, সমাজসেবা ও শিক্ষা সংস্কারে বিশেষত চট্টগ্রামে এবং নিজ গ্রামে নারী শিক্ষা প্রসারে বাবা বরাবর অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। যার দৃষ্টান্তস্বরুপ হাটহাজারী সরকারি পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয়, হাটহাজারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাবার স্মৃতির ধারক ও বাহক হয়ে আছে, থাকবে আগামী দিনগুলিতে। আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে হাটহাজারী সফরকালে বাবা আমাদের তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সদ্যনির্মিত কলেজ ভবন পরিদর্শনে নিয়ে গিয়েছিলেন, মনে হয়েছিলো কী আনন্দের সাথে বাবা তাঁর প্রিয় প্রাঙ্গণে পদচারণা করছেন, এখনও চোখ বন্ধ করলে সে দৃশ্য ভেসে উঠে মানসপটে। এই হাটহাজারী, আজ যেখানে বাবা অন্তিম শয়নে চিরনিদ্রিত আছেন, সেই নিজ গ্রাম, নিজের মাটির প্রতি বাবার এক আশ্চর্য রকমের অবিচ্ছেদ্য টানছিলো। ঢাকায় হাসপাতালে যখন দুরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে সবটুকু শক্তি ও মনোবল উজাড় করে দিয়ে লড়ে চলেছেন, সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে প্রচণ্ড ব্যথা উপশমের, সেই সময়েও বাবা তাঁর নিজের কষ্টকে অতিক্রম করে চট্টগ্রামের দুস্থ রোগীদের কল্যাণে বিশেষ করে ক্যান্সার আক্রান্ত প্রান্তিক রোগীদের শেষ দিনগুলোতে কিভাবে মানসিক ও শারীরিকভাবে বেদনা উপশমের সহজলভ্য ব্যবস্থা প্রদান করা যায় সেই চিন্তা করেছেন।
নিদারুণ দুর্ভাগ্য বাবাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি, আমাদের এই পার্থিব জগতে রেখে শোকের প্লাবনে ভাসিয়ে অনন্তকালের পথে যাত্রা করেছেন বাবা। আগস্ট ২৯, ২০২১ সালে। কিন্তু বাবার অসমাপ্ত মহৎ ইচ্ছা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, বাবার আশীর্বাদপুষ্ট বিভিন্ন জনহিতৈষী কার্যক্রমের মাঝে সর্বোপরি তাঁর একক প্রচেষ্টার ফসল নিজের হাতে গড়ে তোলা চট্টগ্রাম মেডিকেল নিউরোসার্জারি বিভাগের মধ্য দিয়ে বাবার অস্তিত্ব চির জাগরুক হয়ে থাকবে। শেষে বলতে হয়, এই জগতে এই যুগে আক্ষরিক অর্থেই বাবা এক ক্ষণজন্মা বিরল ব্যক্তিত্ব–
অগাধ জ্ঞানের অধিকারী, কিন্তু বিনয়ী, ধর্মপরায়ণ একই সাথে সহনশীল উদারমনা, দেশ ও রাজনীতি সচেতন হয়েও ন্যায়নিষ্ঠাবান ও নিরপেক্ষ, সৌখিন কিন্তু সংযমী। রসবোধসম্পন্ন সদা প্রফুল্ল–এক কথায় আমার বাবা একজন পরিপূর্ণ মানুষের প্রতিচ্ছবি। লেখক : ডা. এল এ কাদেরীর কন্যা ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার