বাবার আলোয় আলোকিত

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২০ জুন, ২০২১ at ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ

সংসারের পেছনে যে মানুষটি দিন-রাত পরিশ্রম করে যান কোনো প্রাপ্তি ছাড়া, তিনি বাবা। নিজের জন্য নয়, সন্তানের জন্য উপার্জন উৎসর্গ করেন। প্রত্যেক সন্তানের সাফল্যের পেছনে আছে বাবাদের নীরব গল্প। আজ বিশ্ব বাবা দিবস। আজকের দিনে তিনজন সফল বাবাকে নিয়ে সফল সন্তানেরা ব্যক্ত করেছেন তাদের অনুভূতি।

ড. সনিয়া কাদেরী
বইয়ের পাতা থেকেই উঠে আসা অসাধারণ আলোকিত বাবা
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নিউরোসার্জন ডা. এল এ কাদেরীর মেয়ে ড. সনিয়া কাদেরী। তিনি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে। এই তড়িৎ প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী কাজ করেন টু-সিঙ ইনকর্পোরেটেডে। বাবাকে নিয়ে অনুভূতি তুলে ধরেছেন তিনি।
বাবা ডাকটি ছোট্ট, কিন্তু এর পরিব্যাপ্তি কি বিশাল! বাবা আমার কাছে আকাশের মতন উদার, সূর্যের মতন দ্যুতিময় এক অস্তিত্ব। পেশাগত জীবনে প্রখর সাফল্যের অধিকারী নিউরোসার্জন হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। তিনি মমতাময় বাবা এবং অসাধারণ একজন মানুষ হিসেবে তার সন্তানদের উদ্বুদ্ধ করেছেন স্বাধীন চেতনায় বেড়ে ৬ষ্ঠ কলাম
উঠতে। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী যেখানে এমন আকাশচুম্বী সফল চিকিৎসক বাবার সন্তানদের পেশা অনুস্মরণ করাটাই স্বাভাবিক, বাবা সেখানে আমাদের শিক্ষাগত এবং পেশাগত সিদ্ধান্তগুলো নিজেদের উপর ছেড়ে দিয়েছেন গভীর ভালোবাসা আর আস্থায়।
ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছ থেকে পেয়েছি বই পড়ার অভ্যাস। শত ব্যস্ততার মাঝেও ছুটির দিনগুলোতে বাবার হাত ধরে বইয়ের দোকানে গিয়ে নতুন সব বই কেনা আমার প্রিয় সুখ স্মৃতি। বাবার কাছেই শিখেছি পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস আর প্রবন্ধ পড়া কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বইয়ের পাশাপাশি সব ধরনের সাপ্তাহিক পত্রিকা যেমন আনন্দমেলা, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কিশোর ভারতী, রিডার্স ডাইজেস্ট, দেশ নিয়মিত সংগ্রহ করে আনতেন আমাদের জন্য।
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ এ কথাটির যেন জলজ্যান্ত প্রমাণ আমার বাবা, যিনি আমাদের অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় ভালো করার পুরস্কারস্বরূপ আমেরিকা থেকে বিশেষভাবে অর্ডার করে উপহার দিয়েছিলেন সমগ্র এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার ৩৩টি খণ্ড, যার আবেদন একদমই আগের মতন, এমনকি এই ওয়েবের যুগেও। এসএসসি থেকে শুরু করে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন অব্দি অনেক না জানা প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি এই এনসাইক্লোপেডিয়ার পাতায়।
এইচএসসি পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডে আমি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম ও সম্মিলিতভাবে ১৩তম হয়েছিলাম। স্নাতক পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড ফিজিঙ বিভাগ থেকে স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম ফ্যাকাল্টিতে সেরা ফলাফলের জন্য। আমার প্রত্যেকটি ফলাফলের পেছনে সবচেয়ে বড় উৎসাহ বাবা আর মা। আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন, মেয়ে হলেও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা যায়। ছেলেমেয়ে সবাই সমান।
আমার এই গুণী বাবার সম্পর্কে আরেকটি কথা বলতেই হয়। একজন লেসার সায়েন্টিস্ট হিসেবে আমার পেশাগত অভিজ্ঞতার সাথে চিকিৎসা শাস্ত্রের মিল নেই বললেই চলে। অথচ আমার দৈনন্দিন গবেষণা এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে বাবার অকুণ্ঠ আগ্রহ এবং সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা যেন তার বিজ্ঞানমনস্ক আর জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তিত্বের চমৎকার বহিঃপ্রকাশ। আমার বইপ্রেমী বাবা যেন তাই বইয়ের পাতা থেকেই উঠে আসা এক অসাধারণ আলোকিত বাবা, যার তুলনা উনি নিজেই।

রিদোয়ান করিম
বাবার মতো মানুষের এখন বড় প্রয়োজন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিমের ছেলে রিদোয়ান করিম। তিনি মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক।
বাবা সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবার নাকি বিদ্যালয়, শিশুদের বড় করে তোলার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। আমার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। আমার জন্য পরিবার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। তার অন্যতম কারণ আমার বাবা। সপ্তম শ্রেণীর সমাজ বিজ্ঞানে পাস করতে কষ্ট হলেও, কাল মার্কসকে বুঝতে কোনো কষ্ট হয়নি। কষ্ট হবে কিভাবে, বাবার মুখে তো রাজনীতি, অর্থনীতি এবং শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব গল্পের মতো শুনতাম। তাতেই তো আমার বড় হওয়া। যদিও আমার জীবননীতিতে মার্কস দর্শনের ছিটেফোঁটাও নেই। থাকবেই বা কীভাবে? আমি যে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার ফসল।
যা হোক, বাবার কথায় আসি। বাবা আমার নিও মার্কসিস্ট না হলেও সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে দেশ, সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে তার কাজের পরিসর কম নয়। বিজ্ঞানীরা ভাবেন বেশি, আমার বাবাও ব্যতিক্রম নয়। আশপাশ নিয়ে বেশি ভাবেন বলেই হয়ত সারাজীবন চট্টগ্রামে রয়ে গেলেন। অফুরন্ত ভালোবাসাও পেলেন চট্টগ্রামবাসী থেকে। কিন্তু আমাদের প্রায়ই বিদেশ নিয়ে যেতেন পৃথিবীকে চেনানোর জন্য। আমরা চিনে রয়ে গেলাম দেশের বাইরে। বাবা কিন্তু ঠিকই রয়ে গেলেন দেশে, তার প্রিয় মানুষগুলোর সাথে, দেশের জন্য কাজ করতে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবার প্রজন্মের মানুষগুলো বুঝি সঠিক হিসেব করতে জানেন না। নাকি আমরাই বুঝি না তাদের হিসেব। জানি না এর উত্তর, জানবই বা কেমন করে, কার্ল মার্কস শুধু পড়ানো হয়েছে। একে জীবননীতিতে একেবারেই প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। কোন প্রজন্ম ঠিক, তা সময় বলে দেবে। কিন্তু বাবার মতো দেশ, জাতি ও সমাজের গঠন নিয়ে কাজ করা মানুষের এখন বড় প্রয়োজন। তাই কামনা করি, যুগে যুগে জন্ম নিক প্রফেসর ড. ওবায়দুল করিম। আর আমার মা আগ্রাবাদ গার্লস কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শাহীন আক্তারের মতো মহীয়সীরা। পৃথিবীর সকল বাবাকে আমার পক্ষ থেকে অনেক শুভেচ্ছা। ভালো থাকুক সকল বাবা। বাবা কখনও বলিনি, আজ বলছি, তোমার জ্ঞানের পরিধি দেখলে আমার হিংসে ও গর্ব দুটোই হয়। ভালো থেকো, তোমার জ্ঞান কিছুটা ধার দিও, যেমনটা তুমি সব সময় দাও।

ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দীন চৌধুরী
বাবা আমার কাছে বটবৃক্ষ আশ্রয়স্থল
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার আবুল বশর চৌধুরীর সন্তান ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দীন চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। বাবা নিয়ে তিনি বলেন, বাবা মানে দুটি শব্দ, কিন্তু এর বিশালতা অনেক বড়। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি বাবাকে। তিনি একজন সৎ, কর্মঠ পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান লোক ছিলেন। সময়ানুবর্তিতা আমি বাবার কাছ থেকেই পাই। বাবা আমার কাছে সাহস আর প্রেরণার উৎস। আমার জীবনে যতটুকু অর্জন সবকিছুতেই বাবার অবদান অনেক বেশি। আমাদেরকে নির্ভার রেখেছেন, অথচ সমস্ত চাপ তার ঘাড়ে। বাবা আমার কাছে বটবৃক্ষ ও শেষ আশ্রয়স্থল।
আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে গড়ে তুলেছেন। পড়ার চেয়ে মানুষের জন্য কিছু করা, কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া এই বিষয়গুলো তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জীবনটা মানুষের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন, গ্রামের বাড়িতে স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ নির্মাণে তার ভূমিকা অনন্য। যেমনটি ছিলেন আমার দাদাও। কর্মজীবনে বাবা ব্যাংকের ঊচ্চপদে আসীন ছিলেন। তিনি সবসময় সৎ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সেবা করার মহান ব্রত আমাকে সেই ছোট বয়স থেকে মনের মাঝে গেঁথে দিয়েছেন। তাই আজ আমি চিকিৎসক হিসাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারছি।
এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জনে বাবার উৎসাহ ও সাহসিকতা আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। বাবাকে কোনোদিন হয়তো জাপটে ধরে বলা হয়নি, ভালোবাসি। আজ বাবা দিবসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতে চাই, বাবা, খুব ভালোবাসি তোমায়। আমাদের সবাইকে জড়িয়ে রেখো সারা জীবন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবা, সুশীতল ছায়া
পরবর্তী নিবন্ধহালদার আশি ভাগ দূষণ কমবে যেভাবে