প্রত্যেকের জীবনে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যারা নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালন করেন তারা আর কেউই নয়, শুধু বাবা আর মা। আমার বাবা ছিলেন খুব নিরহংকারী আর সুন্দর মনের মানুষ। আমার বাবা খুব বেশি ধনী মানুষ ছিলেন না কিন্তু মনের দিক দিয়েছিলেন অনেক উঁচু মাপের মানুষ। বাবা ছিলেন শিপিং সার্ভেয়ার। বেশ অনেক বছর আগ্রাবাদে বাবার নিজের অফিস ছিল। বিলাসী জীবনযাপন বা লোক দেখানো কোন কিছু বাবা পছন্দ করতেন না। আমাদের প্রতি বাবার বুক ভরা ভালোবাসা মুখ ফুটে প্রকাশ করতেন না বা আহ্লাদে বাড়াবাড়ি দেখাতেন না। অথচ আমরা দুই মেয়ে ও তার তিন নাতি নাতনি ছিল বাবার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। আমরাও বাবাকে খুব সমীহ করে চলতাম। তাই যে কোন কাজ করতে গেলে চিন্তা করতাম বাবা সেটা কীভাবে নেবে। আমাদের উচ্চশিক্ষা বা সরকারি চাকরি তার অনেকাংশই আমার বাবার অবদান। বাবা মেয়েদের চাকরি করাকে পুরোপুরি সমর্থন করতেন। বাবা বলতেন যতই ধনী পরিবারে বিয়ে হোক না কেন মেয়ের কপালে লেখা থাকে না সে এমএ পাস। চাকরি একটা মেয়ের বিপদের দিনে মাথায় ছাতা হয়ে দাঁড়ায়। যে পরিবারে মেয়েদেরকে চাকরি করতে দেবে না বলেছে ঐ ধরনের পরিবারে বাবা মেয়েকে বিয়েও দেননি। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন মুখের উপর। বাবা কথা বার্তায় ছিলেন খুবই স্পষ্টভাষী। এজন্যই অনেক সময় অনেক মানুষের অপ্রিয় হতেন। বাবাকে দেখতাম খুব শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন যাপন করতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। গীতা পাঠ করতেন। কখনো অলসতা করে কোনো কাজ একদিনের জন্যও ফেলে রাখতেন না। তখনকার সময়ের মানুষ হয়েও বাবা কম্পিউটার এবং ইংরেজি ও হিন্দি বলাতে ছিলেন চমৎকার পারদর্শী। তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে বাবার এত দক্ষতা ছিল যে আমরা এই প্রজন্মের মানুষ হয়ে সেসব এত ভালো জানি না। বাবা বলতেন, টাকা দিয়ে সব কিছুকে বিচার করবে না। আর টাকা উপার্জনের জন্য কখনো বেশি ছুটবে না। জীবনে ভালো থাকতে খুব বেশি টাকার প্রয়োজন পড়ে না। তাইতো বাবার বিদেশে যাবার সুযোগ হলেও নিজের মা–বাবা, পরিবারের কথা চিন্তা করেই কখনো সে পথে যাননি। বাবাকে দেখেছি ভাইবোনদের জন্য যতটা সম্ভব নিজের সব কর্তব্য করে গেছেন। বাবার বন্ধুর মুখে শুনেছি বাবা চুপিসারে গিয়ে অনাথ আশ্রমে দান করে আসতেন। অথচ বাবার জীবদ্দশায় আমরা কেউ কোনদিন এটা জানতামও না। কিন্তু বাবাকে হারিয়ে ফেললাম চোখের পলকেই। দিনটি ছিল ২০২০ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর। আগের দিন বাবা বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলে নগরীর একটি নামী হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করালাম। বাবাকে আইসিইউতে দেয়া হয়েছে। রাত সাড়ে আটটার দিকে বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। একটা দিনের জন্য বাবা কাউকে তার জন্য কোন কষ্ট করতে দেননি। আমাকে কেউ এখন আর আদর করে ‘মনিয়া‘ বলে ডাকে না। বাবা তুমি চলে গেলেও তোমাকে অহর্নিশ মনে পড়ে। আমার মনের মনিকোঠায় শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় তুমি বেঁচে থাকবে আজীবন। আর যতদিন বেঁচে থাকব তোমার আদর্শে জীবনে চলার চেষ্টা করব। পরলোকে তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি।