বাবা-মেয়ের ঘুম আর ভাঙেনি

ষোলশহরে পাহাড় ধসে মৃত্যু ।। রেলের খালাসি খালেকের জন্যই এই দুর্ঘটনা ।। পাহাড় কেটে ১শ ঘর করেছেন, মানা করলে ভয় দেখাতেন

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৮ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

রোজ ভোর ৫টায় নগরের ষোলশহর রেলস্টেশনে নিজের চাদোকান খুলে ক্রেতার অপেক্ষা করেন আবদুল আউয়াল সোহেল (৩৫)। ভারী বৃষ্টি হওয়ায় গতকাল দোকানে যাননি তিনি। স্টেশনের পাশেই আইডব্লিউ কলোনিতে নিজের বাসায় ঘুমিয়েছিলেন সাত মাস বয়সী সন্তান বিবি জান্নাতকে নিয়ে। বাবামেয়ের সেই ঘুম আর ভাঙেনি। পাহাড় ধসে মারা যান তারা।

গতকাল সকাল ৬টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় সোহেলের সঙ্গে একই বিছানায় ছিলেন তার স্ত্রী শরীফা বেগম ও বড় মেয়ে বিবি কুলসুম (১২)। ঘরের উপর পাহাড়ের মাটি পড়ার শব্দ শুনে দ্রুত বের হওয়ার সময় আটকে যান তারা। চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে উদ্ধার করে তাদের। এ সময় মাথায় আঘাত পান শরীফা। কুলসুমও আহত হয়।

জানা গেছে, আইডব্লিউ কলোনির পাহাড়টির উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট। খাড়া এ পাহাড়ের মাটি কেটে ঘর নির্মাণ করে রেলওয়ের খালাসি পদে কর্মরত আবদুল খালেক। সেখানে একটি রিটেইনিং ওয়ালও নির্মাণ করে। ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটির সাথে দেয়ালটিও ভেঙে পড়ে সোহেলের ঘরে। তার স্বজনদের দাবি, দেয়ালটি নির্মাণের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

পাহাড় ধসের ঘটনায় আবদুল খালেককে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছেন সোহেলের ভাই। এদিকে ঘটনার তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে আজাদীকে জানান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি বলেন, তদন্তে যা উঠে আসবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আইডব্লিউ কলোনিতে কান্নার রোল : গতকাল সকালে ঘটনাস্থল আইডব্লিউ কলোনিতে গিয়ে দেখা গেছে, সোহেলের প্রায় পুরো ঘরটায় ভেঙে গেছে। সেখানে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে হাঁড়িপাতিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্র। সোহেলের স্ত্রী শরীফা ও মেয়ে কুলসুম পাশের একটি ঘরে অবস্থান করছেন। তাদের চারপাশে ছিল স্বজন ও প্রতিবেশীদের জটলা। কিছুক্ষণ পর পর মুর্ছা যাচ্ছিলেন শরীফা। জ্ঞান ফিরতেই আহাজারি করছিলেন তিনি। বলেন, ‘ও আল্লাহ, আমার জান্নাত কই। ও আল্লাহরে আঁই কি লইয়া বাঁচুম? আমার ঝি গেছে গা, জামাইও গেছে গা। অহন আঁই কি লইয়া বাঁচুম? আমার সব শেষ।’ এ সময় স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তাদের চোখেও ছিল পানি।

ঘরের বাইরে ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। স্থানীয়রা জানান, তিনি আহত শরীফার মা। নাতনির জন্য তার বুকফাটা কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পুরো কলোনি।

শরীফার বোন পরিচয় দিয়ে কান্নারত এক মহিলা জানান, জান্নাতকে বেশি ভালোবাসত সোহেল। তাকে নিজের দোকানে নিয়ে যেত। বেচাবিক্রির ফাঁকে মেয়েকে আগলে রাখত। মেয়েও ছিল বাবাভক্ত। তাদের সে ভালোবাসাকে বিচ্ছিন্ন না করতেই বোধ হয় আল্লাহ দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে গেছে।

জানা গেছে, সোহেল ও শরীফা দম্পতির বাড়ি ফেনী জেলায়। বহু বছর ধরে চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছেন তারা।

শরীফার জা সাজিয়া আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, তিনজনে ভেঙেছি দরজা, ভেঙে দেখি ওরা সবাই মাটির নিচে। তিনজনের পা দেখা যাচ্ছিল, ছোটটার (জান্নাত) কিছুই দেখা যায়নি। আমরা টেনে কুলসুম ও শরীফাকে বের করছি।

ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, সকাল ৭টার দিকে আমরা খবর পেয়েছি আইডব্লিউ কলোনিতে পাহাড় ধস হয়েছে। দুর্ঘটনার সময় ঘরে সদস্য ছিল চারজন। তাদের স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর মধ্যে দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তিনি বলেন, আইব্লিউ কলোনির এ পাহাড়ের উচ্চতা ৬০ ফুট হবে। এখানে আশেপাশে যারা থাকেন সবাই ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বৃষ্টিতে আবারও পাহাড় ধস হলে প্রাণহানি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই লোকজনকে নিরাপদে সরে যেতে আমরা মাইকিং করছি।

পাহাড় কেটে দেয়াল দেন রেলের খালাসি খালেক : স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, রেলওয়ের খালাসি পদে কর্মরত আবদুল খালেক পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করেছেন। যেখানে ধসের ঘটনা ঘটে তার উপরে পাহাড়ে রয়েছে খালেকের বসতঘর। সেখানে কয়েকদিন আগেও নতুন করে বসতি নির্মাণ করতে খালেক নিজেই তার তিন সন্তানকে সাথে নিয়ে পাহাড় কাটেন। কিছুদিন আগে পাহাড় কেটে সেখানে একটি রিটেইনিং ওয়ালও নির্মাণ করেন। কিন্তু সেটার গভীরতা তেমন ছিল না। ফলে ভারী বৃষ্টিতে মাটি সরে দেয়ালটিসহ ধসে পড়ে পাহাড়।

নিহত সোহেলের মেয়ে বিবি কুলসুম সাংবাদিকদের বলে, আবদুল খালেক দেয়াল দিয়ে ঘর নির্মাণ করেছেন। তাকে দেয়াল দিতে আমরা নিষেধ করি। আমার বাবাও মানা করেছিল। কিন্তু কথা শুনেননি। শুনলে আজ এ দুর্ঘটনা ঘটত না। বাবা ও বোনকে হারাতাম না। সে বলে, আমিও ছিলাম মাটির নিচে। আমাকে টেনে বের করেছে। তাই বেঁচে গেলাম।

কুলসুমের চাচি সাজিয়া বলেন, গত ৮১০ দিন ধরে খালেক মাটি কেটে দেয়াল তোলেন। এ দেয়াল না দেওয়ার জন্য সবাই তাকে নিষেধ করে। তিনি (খালেক) বলেছিলেন, আমাদের বাঁচার জন্য নাকি এ দেয়াল দিয়েছেন। কিন্তু সে দেয়াল তো উল্টো প্রাণ কেড়ে নিল। সাজিয়া জানান, তার বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর হয়েছে। বিয়ের পর থেকেই পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন। খালেকের দেয়াল দেওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এদিকে ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন আবদুল খালেক।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাসুদ রানা বলেন, স্থানীয় তদন্তে জানা গেছে আবদুল খালেক পাহাড় কাটায় জড়িত। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও জেলা প্রশাসনের কাছে আছে।

জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর আইডব্লিউ কলোনিস্থ শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবামন্দির ও পূজনালয়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর আবদুল খালেকের পাহাড় কাটা নিয়ে অভিযোগ করেন। একই সাথে পাঁচলাইশ থানায় তার বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করা হয়।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা আজাদীকে বলেন, ভিকটিমের ভাই বাদী হয়ে আবদুল খালেক ও সহযোগীদের আসামি করে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছেন। গত রাত সাড়ে ৯টায় এ রিপোর্ট লেখাকালীন আবদুল খালেককে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানান তিনি।

ওই এলাকার অধিকাংশ লোকজনের দাবি, খালেকের জন্যই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় কাটতে মানা করলে তিনি এলাকাবাসীকে প্রশাসনসহ নানা ভয়ভীতি দেখাতেন।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৮ বছর আগে খালেক আইডব্লিউ কলোনিতে বসবাস শুরু করেন। তখন তিনি ওই এলাকায় প্রচার করেন তিনি পাহাড় লিজ নিয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরে পাহাড় কেটে টিনের ঘর তৈরি করে ভাড়া দেন। এ ধরনের প্রায় ১০০ ঘর রয়েছে তার। প্রতি ঘর থেকে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা ভাড়া আদায় করেন। সম্প্রতি সোহেলের ঘরের পাশে পাহাড় কেটে একটি ঘর তৈরি করে ভাড়া দেন। ওই সময় পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন সোহেল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনালায় পড়ে নিখোঁজ দেড় বছরের শিশু
পরবর্তী নিবন্ধমহালছড়ি-সিন্দুকছড়ি সড়কে পাহাড় ধস, যান চলাচল বন্ধ