‘এক ব্যাগ হাওয়া দিয়ে এসেছি বাবার কবরে। যাই না অনেকদিন সে নির্জনতায়। সেখানে এখন ডর লাগে। আমি গেলে বুকের পাড়ার ঘাম নড়ে ওঠে। দু‘একটি নাম না জানা পাখির আয়াত কানের পাশ ছুঁয়ে ওড়ে যায়। বাবা বলে এরাই তো আমার কবর হাওয়া। যে কোনো চোখের কংকাল শেষ ‘র‘ বর্ণের ধারাপাত বুকে এসে টুপ করে লাগলে শীত–শীত লাগে। এই বনবাসে আছি তো অনেকদিন…তুই তো জানিস আমার গৃহ কাতরতা খুব বেশি, কোথাও গেলে দুই – তিন দিন বাদে ফিরে আসি তোর মা‘র কাছে। ফিরে আসার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই, আছে ঘ্রাণযুক্ত পিপাসা।
অথচ, এখানে যারা আছে, সবাই নিজের মতো, সবাই স্বার্থপর এক –একজনকে নিয়ে সংসার, একাকীত্ব, নীরবতা আর কতদিন থাকতে হবে, জানি না! কেউ –কাউকে খেতে ডাকে না, এমনই আজব দুনিয়া। কারো কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নেই।
তুই এখন আসিস না। তোর ছেলে–মেয়েদের প্রথমে একটি মানতাসা গ্রাম কিনে দিস। অফুরন্ত চিনি আর ময়দা নিয়ে যেদিন সুবর্ণ কবরগাঁ হবে, সেদিন আসিস – ৭১ বছর ৩ মাস ৩ দিন পর। ” এ–ই কবিতাটির জন্মসাল মনে নেই। সম্ভবত, বাবার মৃত্যুর কমপক্ষে এক দশক পর লিখেছি। ভাবি, এত দেরিতে কেন আবেগ অনুভূতির জন্ম হয়। কেন হয় না সাথে সাথে! বাবা তো ভীষণ কাছের রক্তের উত্তরাধিকার, নাড়ীর স্পন্দন – যার ঔরসে আমার জন্ম। যে আমাকে জন্ম দিয়েছে। শুধুমাত্র চর্মচক্ষু দিয়ে পৃথিবী দেখার জন্য নয় তার–ও বেশি চেনার সুযোগ করে দিয়েছে জীবনের পাঠ। জন্মের কালপরিক্রমায় প্রথাগত নিয়মানুযায়ী আমরা পৃথিবী নামক এ–ই গ্রহে, প্রত্যেকে বাবার হাত ধরে। আজ যারা সন্তান তারা ভবিষ্যতের বাবা। এ–ই অসীম মুগ্ধ পারিবারিক ধারাবাহিকতায় তৈরি হতে থাকে যুগ যুগ সময় ধরে। বাবা হওয়ার আগে কখনো বুঝি নি বাবা সংসারের কী অধিকর্তা! বাবাকে দেখতাম ভীষণ মোটা কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে রাশভারী একজন মানুষ। প্রয়োজনের বাইরে কম কথা বলা মানুষ। আবার একদম যে স্বল্পবাক, তা–ও না। ভালো মন্দ আলাপ–আলোচনায় মাঝেমধ্যে তাঁর মহাজগতের খোঁজ পেতাম। গুন গুন করে গাইতেন নানাধরনের পুরনো দিনের রোমান্টিক গান। কণ্ঠ যা–ই হোক তিনি যে হৃদয়ে সঙ্গীত ধারণ করতেন, সেটি খেয়াল করার মতো। বাবা–র কণ্ঠে শুনতাম ‘মান ঢোলে মের্যা তান ঢোলে ম্যারা দিল ক্যা গিয়া ক্যারারে, ইয়ে কোনো বাজায়ে বাঁসুরিয়া’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লিখিত ও সুরারোপিত গান। কিংবা প্রায়শই শুনতাম ; ধীরে ধীরে আ্যরে ব্যাদল, ধীরে ধীরে য্যা,,, গানের রচয়িতা অরুণ কুমার কণ্ঠশিল্পী আমিরবাঈ কর্ণাটকী। এরকম স্মৃতি বিজড়িত আরও অনেক পুরনো গান। কালের গর্ভে বেঁচে যাওয়া গান। গানের কথা যেমন গভীর জীবন জিজ্ঞাসায় ব্যাপৃত ছিল তারও বেশি সুরের মায়াবী ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন। চটুল সুন্দর ফুরফুরে মেজাজের রোমান্টিক গান সে–স্বর্ণসময়ের অলংকার। অফিস ফেরত বাবাকে দেখতাম উপন্যাস ও গল্প পড়তে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার কলামে মুখ ডুবিয়ে রাখতেন ধ্যানে। কিছু বাবারা এই তিনের অতল সমীকরণ। আবার কঠিন বাবার অন্তরালে সরল সুন্দর অবুঝ বাবা বাস করে। আজকালকার আধুনিক বাবারা যেমন বন্ধু সংজ্ঞায় ছেলেমেয়েদের সাথে নানা কিসিমের গল্প ঠাট্টায় মিশে গিয়ে প্রেম ভালোবাসা যৌনতা খেলাধুলা রাজনীতি সমাজনীতি খুনখারাবি ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে পারে অনায়সে, তেমনটা না। তখনকার বাবারা ছিল ছেলেমেয়েদের দূরের বন্ধু। অনুভূতিময় খুব গভীর থেকে ভাববার একটা খালি স্পেস। যতটুকু কাছে এলে বাবা মা‘কে পাওয়া যাবে, আচ্ছন্নতা থাকবে, ঠিক ততটুকু। আবার যতটুকু গেলে দূরত্ব তৈরি হবে, ততটুকু না। একটা প্রত্যক্ষ শাসন – নিয়ন্ত্রণে তটস্থ থাকতো পরিবারের অন্য লোকজন। কারণ বাবার ওপরে কথা বলবার মানুষ ছিল না সে– কালে। বাবা ছিল পরিবারের প্রধান মানুষ। তাকে কোনোভাবে অমান্য করার ব্যাপার জানাজানি হলে, সেদিন খবর ছিল গোটা পরিবারের, এমনকি নিকটতম আত্মীয় –পরিজনের। বাবারা চাকরি অথবা ব্যবসা করতো ঠিকই কিন্তু সন্তানদের তালাশ করতো গভীরভাবে। তখনকার বাবাদের নিজের আমোদের জায়গা ছিল ভিন্ন এবং ব্যক্তিগত। অফিস কিংবা অন্যান্য কাজ থেকে ফেরার পর দুই ব্যাটারি ট্রানজিস্টার রেডিও নিয়ে মূল বাড়ির ফটকের বাইরে কাছারি ঘরে আরাম করে গান শুনতো। এতে মাঝেসাঝে যুক্ত হতো পাড়ার সমবয়সীরা, সাথে আড্ডা ও তাসখেলা। এখনকার বাবারা অফিসে ও অন্যান্য কাজের বাইরে কম্পিউটার ও ফেসবুক নিয়ে হুলুস্থুল ব্যস্ত। অনেকে সান্ধ্যনগরীর হাইটেক ক্লাব সোসাইটি নিয়ে তুমুল ব্যস্ত। বিত্তশালী বাবাদের সর্বদা অপ্রয়োজনীয় দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে অভ্যস্ত এ সামাজ। বাবাদের অনুসরণ করে সন্তানরেও সে দিকে ধাবিত হয়। অনিবার্য সংঘাত শুরু হয় বাপ ছেলের মধ্যে। বাবা মনে করে অভিজ্ঞতা তার বড় অর্জন। ছেলে ভাবে সে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান। ভাবছি, এসময়ে এসে আমি বাবা হিসেবে ভালো না আমার বাবা ভালো ছিল? না–কি আমার সন্তান যে সদ্য বাবা হয়েছে সে ভালো। সময়ের হিসেবে বাবাদের শ্রেণিবিভাজন থাকলেও, বাবার চিরকালীন বৈশিষ্ট্য পুরোটা পাল্টে যায় নি। ভঙ্গুর পুঁজিবাদ ও অব্যবস্থাপনা এবং অবিরাম সামাজিক নৈরাজ্য বাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা পাল্টে দিয়েছে। বাবারা সন্তানমুখীনতার চেয়ে বেশি অর্থমুখী। ফলে দেশের তরুণ সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ক্রমশই সীমিত হয়ে শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
বাবা–কে কেন্দ্র করে প্রতিবছর বিশ্বের ১১১ টি দেশ বাবা দিবস পালন করে জুন মাসের তৃতীয় রোববার। এই দিবস পালন শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া চার্চের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল আবেগী জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেছে দিবসটি পালনের যথার্থতা কোথায়। সাধারণত পরিবারে মায়ের সঙ্গেই সন্তানদের সম্পর্ক গভীর হয়। ইউরোপ এশিয়ায় কম বেশি এটি দৃষ্ট হয়, খুব সহজে। আবার দেখা যায় এই উপমহাদেশে বাবার সঙ্গে সন্তানদের হরহামেশাই একটা দূরত্ব তৈরি হতেই থাকে। পরিবারে বাবার অবদান ও ভালোবাসা কম নয়, বরং মায়ের চেয়েও বেশি ; এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বাবা দিবস। একদম সরলীকৃত বিষয়টি। আমার মনে হয়েছে বাবাকে রূপকার্থে প্রতিকায়িত করে সাম্রাজ্যবাদকে সর্বদা এগিয়ে রাখা। কেন না পরিবার একটা রাষ্ট্রের মতন। পরিবারের প্রধান বাবা। সে বাবা ক্ষমতাশালী দণ্ডায়মান পুরুষ। তার নিয়ন্ত্রণে থাকে অন্যান্য সদস্যগণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ক্ষমতাবান সম্পদশালী রাষ্ট্র। নিজেদের অন্য রাষ্ট্রের তুলনায় বড়ো ভাবা মার্কিনী স্বভাব। যদি পরিবারের বাবাকে প্রতিকায়িত করে রাষ্ট্রীয় দুরভিসন্ধি সর্বদা জিইয়ে রাখা যায় তাহলে ক্ষমতা ও আধিপত্যবাদী দর্শন চিরকাল টিকে থাকে। এখানে বাবাটা খেয়াল, একটা ভিন্ন ইঙ্গিত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বিকাশের অস্ত্র। ফলস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা বাবারাষ্ট্র ; এটা বোঝানোর জন্য কি বাবা দিবস!
আমাদের উত্তর ঔপনিবেশিক এশিয়ান আবেগ; একজন বাবার হৃদয় প্রকৃতির এক অপার স্থান। একজন বাবা ১০০ শিক্ষকের সমান। বাব ছেলের ভালোবাসা থেকে কিছুই বড় হতে পারে না।
দেবতা প্রমিথিউস ভালোবেসে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মর্ত্যের মানবতা কে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন তেমনি একজন বাবা তার সন্তানদের জন্য অপরিহার্য ছায়া। বাবা স্পর্শকাতর বাস্তবের দেবতা। সন্তানরা একেকটা দেবশিশু। এই আবেগ কিছুটা পাশ্চাত্যের, অনেকটা প্রাচ্যের মানুষের। বাবা নির্দিষ্ট একটা দিনের, দিবসের বিষয় না। বাবাকে সব দিনে সন্তানের বাবা হয়ে উঠতে হয়।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।