‘বাদল–দিনের প্রথম কদম ফুল
করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান
মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে
রেখেছি ঢেকে তারে
এই–যে আমার সুরের ক্ষেতের
প্রথম সোনার ধান’
বর্ষা আসবে অথচ বাঙালি গুনগুনিয়ে গাইবে না এই গান তা কী করে হয়। যখন বাঙালির সমস্ত সত্তা জুড়ে বিরাজ করেন রবীন্দ্রনাথ।
শ্যামল বাংলায় এসে রবীন্দ্রনাথের এক অপূর্ব বর্ষাদর্শন হয়েছিল। তাই তাঁর লেখা ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে বর্ষাদিনের এক অসাধারণ চিত্র পাওয়া যায়।
“তখন পূর্ণবর্ষায় বাংলাদেশের চারিদিকেই ছোটো বড়ো আঁকাবাঁকা সহস্র জলময় জাল বিস্তীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। সরস শ্যামল বঙ্গভূমির শিরা–উপশিরাগুলি পরিপূর্ণ হইয়া তরুলতা তৃণগুল্ম ঝোপঝাড় ধান পাট ইক্ষুতে দশ দিকে উন্মত্ত যৌবনের প্রাচুর্য যেন একেবারে উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছে।
শশিভূষণের নৌকা সেই–সমস্ত সংকীর্ণ বক্র জলস্রোতের মধ্য দিয়া চলিতে লাগিল। জল তখন তীরের সহিত সমতল হইয়া গিয়াছে। কাশবন শরবন এবং স্থানে স্থানে শস্যক্ষেত্র জলমগ্ন হইয়াছে। গ্রামের বেড়া, বাঁশঝাড় ও আমবাগান একেবারে জলের অব্যবহিত ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে— দেবকন্যারা যেন বাংলাদেশের তরুমূলবর্তী আলবালগুলি জলসেচনে পরিপূর্ণ করিয়া দিয়াছেন।
যাত্রার আরম্ভকালে স্নানচিক্কণ বনশ্রী রৌদ্রে উজ্জ্বল হাস্যময় ছিল, অনতিবিলম্বেই মেঘ করিয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইল। তখন যে দিকে দৃষ্টি পড়ে সেই দিকই বিষণ্ন এবং অপরিচ্ছন্ন দেখাইতে লাগিল। বন্যার সময়ে গোরুগুলি যেমন জলবেষ্টিত মলিন পঙ্কিল সংকীর্ণ গোষ্ঠপ্রাঙ্গণের মধ্যে ভিড় করিয়া করুণনেত্রে সহিষ্ণুভাবে দাঁড়াইয়া শ্রাবণের ধারাবর্ষণে ভিজিতে থাকে, বাংলাদেশ আপনার কর্দমপিচ্ছিল ঘনসিক্ত রুদ্ধ জঙ্গলের মধ্যে মূকবিষণ্নমুখে সেইরূপ পীড়িতভাবে অবিশ্রাম ভিজিতে লাগিল। চাষিরা টোকা মাথায় দিয়া বাহির হইয়াছে; স্ত্রীলোকেরা ভিজিতে ভিজিতে বাদলার শীতল বায়ুতে সংকুচিত হইয়া কুটির হইতে কুটিরান্তরে গৃহকার্যে যাতায়াত করিতেছে ও পিছল ঘাটে অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলিয়া সিক্তবস্ত্রে জল তুলিতেছে, এবং গৃহস্থ পুরুষেরা দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছে, নিতান্ত কাজের দায় থাকিলে কোমরে চাদর জড়াইয়া জুতা–হস্তে ছাতি–মাথায় বাহির হইতেছে— অবলা রমণীর মস্তকে ছাতি এই রৌদ্রদগ্ধ বর্ষাপ্লাবিত বঙ্গদেশের সনাতন পবিত্র প্রথার মধ্যে নাই।”
এর চেয়ে ভালো বর্ণনা আর কোথা পাই বলুন।
বর্ষা বাঙালির জীবন জুড়ে আছে আনন্দ–বেদনায়, হরিষে ও বিষাদে। গ্রীষ্মের খরতাপে দগ্ধ ভূমিতে বর্ষার বাদল আসে সৃষ্টির এক আনন্দ বার্তা নিয়ে আবার অতি বর্ষায় যখন মাঠঘাট ডুবে যায়, কৃষকের ফসল তলিয়ে যায়, নদীর ভাঙনে মানুষের বসতবাড়ি ভেসে যায় তখন বর্ষা বিষাদ বয়ে আনে অনেকের মাঝে। তারপর সে বিষাদও কেটে গিয়ে জনজীবনে স্বস্তি নিয়ে আসে, সৃষ্টির বারতা নিয়ে বর্ষা বয়ে আনা উর্বর পলিমাটিতে আবার ফসল ফলানোর মহাযজ্ঞ। এভাবে বর্ষা বাঙালির জীবন জুড়ে আছে।
আষাঢ়–শ্রাবণ দুমাস নিয়ে বর্ষাকাল হলেও লক্ষ্য করা যায় দুমাসে বারিপাতের ধারা বা ধরন এক নয়। আষাঢ়ে বৃষ্টি হয় ভারী। তা অনবরত কয়েকদিন ধরে চলে। আর শ্রাবণের বৃষ্টি হলো ঝিরিঝিরি, থেমে থেমে।
বর্ষা বাঙালির এক উজ্জ্বল প্রাপ্তি। পৃথিবীর অনেক দেশে বর্ষা নেই। কোটি কোটি মানুষ বর্ষার এই অপূর্ব দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত। বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাওয়া, সে ভেসে যাওয়ার মধ্য থেকে জীবনের গান গেয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই বিশ্বের অনেক জাতির। প্লাবনে নদীর দুকূল উপচে পড়া স্রোতধারা, বন্যার জলে একাকার হয়ে যাওয়া পথঘাট, পুকুর–বিল আর তারই মাঝে কলাগাছের ভেলায় ভেসে থাকা মানুষ–এমন দৃশ্য পৃথিবীতে বিরল। এ যেন শুধুই বাঙালির, এ যেন শুধুই বাংলাদেশের।
বর্ষা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই মহাকবি কালিদাস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’–এর জন্য। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে একবছরের জন্য নির্বাসিত হয়েছিলেন যক্ষ। সেখানে বিরহে কাতর যক্ষকে ব্যাকুল করে তুলেছিল বর্ষা। প্রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার যাতনা নিয়ে মেঘকে দূত কল্পনা করে যক্ষ অনুরোধ করেছে তার প্রিয়ার কাছে খবর পৌঁছে দিতে।
যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে খবর পাঠাতেন। কী করে একখণ্ড মেঘ এক বিরহীর কল্পনায় হয়ে উঠছে বিশ্বস্ত বার্তাবাহক। মেঘকে ইন্দ্রিয়ানুভবের মাধ্যমে মেঘের স্তুতি করে যক্ষ বলছে,
‘ওগো মেঘ, আমি জানি তুমি পুষ্কর এবং আবর্তক মেঘের বংশে জন্মগ্রহণ করেছ, তুমি ইন্দ্রের প্রধান সহচর, তুমি তোমার ইচ্ছানুযায়ী রূপগ্রহণ করতে পারো! অদৃষ্টবশে আমার প্রিয়া আজ দূরবর্তী, তাই তোমার কাছে আমি প্রার্থী হয়ে এসেছি; গুণবান ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা যদি ব্যর্থ হয় তবে তাও ভালো, অধম ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা সফল হলেও তা বরণীয় হতে পারে না।’
মেঘদূত কালিদাস রচিত একটি কাব্য। অনেকের মতে এটি কেলিকাব্য, ক্রীড়কাব্য, খণ্ডকাব্য বা মহাকাব্য; আরেকদল গবেষক এটিকে “বর্ষাকাব্য”, “বিরহকাব্য” বা “গীতিকাব্য” নামে অভিহিত করেন।
মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত কালিদাসের মেঘদূত দুটি খণ্ডে বিভক্ত। পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ। যদিও এই বিভাজন কবি নিজে করেননি। পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ অংশের শ্লোকসংখ্যা যথাক্রমে ৬৩ ও ৫৪। পূর্বমেঘ অংশের আলোচ্য বিষয় হলো নিসর্গবর্ণনা। আর উত্তরমেঘ অংশের আলোচ্য কুবেরপুরী অলকার বিলাসবৈভব ও যক্ষপ্রিয়ার বর্ণনা। কেউ কেউ পূর্বমেঘ অংশটিকে কাব্যের ভূমিকা মনে করেন এবং উত্তরমেঘ অংশটিকে মূল কাব্যের মর্যাদা দেন।
মেঘদূত ছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলীতেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে অবলীলায়। তাদের রচিত কাব্য–গানে বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে। এই প্রবণতা মধ্যযুগের বাংলা কবিতা ও গানেও ছিল। চণ্ডীদাসের কোনো কোনো কবিতায় বর্ষা এসেছে রাধা–কৃষ্ণের প্রেমের প্ররোচনা হিসেবে। মধ্যযুগের কবিরাও বর্ষাকে অভিসার ও বিরহের কাল হিসেবে কল্পনা করেছেন।
বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে দেখতে পাই কৃষ্ণের জন্য রাধার বিরহের যন্ত্রণা বেড়ে যায় এই বর্ষা এলেই। সেখানে বর্ষায় অভিসারে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে রাধা নিজের ঘরের মধ্যে পানি ছিটিয়ে কর্দমাক্ত করে কাঁটা পুতে রেখে রাতের অন্ধকারে তার ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভের সাধনা করতেন। যেন বর্ষায় প্রিয় কৃষ্ণের অভিসারে যেতে পথের কাঁটা তার বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়।
বর্ষা নিয়ে লিখেননি এমন বাঙালি কবি খুঁজে পাওয়া বড় দুষ্কর। এঁদের মধ্যে কবিগুরুর মতো এত কবিতা, এত গান আর কেউ লিখেননি। বর্ষা বাঙালির মন ও মননে কেমন প্রভাব ফেলে তার অপূর্ব বর্ণনা আছে তাঁর এই কবিতায়–
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়–
এমন মেঘস্বরে বাদল–ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার–
জগতে কেহ যেন নাহি আর।।
তাঁর সোনার তরী কবিতায়ও বর্ষার এক অসাধারণ চিত্র পাই।
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা
কুলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষরধারা
খরপরশা–
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
তাঁর রচিত গান– ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ কিংবা ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’ বা ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী। উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে। নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে। রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম।’ বর্ষা নিয়ে তাঁর শুধু গানই আছে ১১৫টি।
আসলে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় বর্ষা ঋতুটা ধরা দিয়েছে এক স্নিগ্ধ শ্যামল রূপে। একমাত্র কালিদাসের ‘মেঘদূত’ ছাড়া বর্ষার কাব্যগাথা আর কোনো সাহিত্যে এমন রূপে বাধা পড়েনি। মেঘদূতে যেমন বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লেখা হয়েছে তেমনি রবীন্দ্র সাহিত্যে, কবিতা ও সংগীতে, বর্ষা এসেছে এক অনির্বচনীয় অনুভব ও মানবের হৃদয়ের আকুতি নিয়ে।
খুব সাধারণ মানুষকে বর্ষা কীভাবে প্রভাবিত করেছে তার উল্লেখ পাওয়া যায় আমাদের পল্লীগীতি বা লোকগানেও। তেমন একটি গান–
‘আষাঢ় মাসের বৃষ্টি রে,
ঝমঝমাইয়া পড়ে রে,
বন্ধু আমার রইল বৈদেশ গিয়া,
রইল বৈদেশ গিয়া।’
এ–গানে এক গ্রাম্যবালার বিরহকাতরতার এক হৃদয়স্পর্শী চিত্র ফুটে উঠেছে। বিদেশে অবস্থানরত প্রেমিকের জন্য তার মন কেমনকরা অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে সহজ–সরলভাবে।
চট্টগ্রামের লেখক সুচরিত চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত আঞ্চলিক নাটক আমেনা সুন্দরীতে বর্ষার বিরহের এক অপূর্ব চিত্র এঁকেছেন এভাবে–
‘ঝড় পরেদ্দে লোছা লোছা
উজান উডের কৈ
এ’ন বরিষার কালে
থাইক্কুম কারে লই
আঁই থাইক্কুম কারে লই।’
বৃষ্টি পড়ছে ঝুমঝুম। সে বৃষ্টিতে অস্থির হয়ে ওঠা কৈ মাছ কানকা দিয়ে উজানে ওঠার দৃশ্য দেখে এক বিরহে কাতর নারীর মনোবাঞ্ছা তুলে ধরা হয়েছে এই গানে।
বাংলাদেশের অন্যতম কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর অনেক উপন্যাস ও নাটকে বর্ষাকে মহিমান্বিত করে তুলেছিলেন। তিনি এই প্রজন্মের কাছে বর্ষা এবং বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রসম্ভারকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন।
তাই বর্ষাকে বলা যায় বাঙালির একান্ত প্রিয় ঋতু। যে ঋতুকে শুধু চক্ষুষ্মান করা নয়, হৃদয়ে দিয়ে অনুভবও করতে হয়।