এটি সর্বজনবিদিত যে, চলমান যুদ্ধ–বিগ্রহসহ নানামুখী উদ্ভূত সমস্যায় বৈশ্বিক আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থা প্রায় পর্যুদস্ত। অধিকন্তু বিশ্বরাজনীতি জটিল থেকে জটিলাকার রূপ পরিগ্রহ করে চলছে। এই সংকট খুব শীঘ্রই দূরীভূত হওয়ার নয়। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন শুল্কনীতি সমস্যাকে আরও তীব্র ও দীর্ঘায়িত করছে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও এর প্রভাবে অর্থনৈতিক সকল সূচকেই সন্তোষজনক অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেশের মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতায় ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজারে ডলারের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রারও সংকট তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। টালমাটাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে প্রতিভাত। প্রবাসীদের অতি কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের উপর ভর করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাত সচলে সহায়ক হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তনে এর অবদান অতি সুস্পষ্ট। দেশের জিডিপিতে অবদান রাখা এই রেমিট্যান্স পরিণত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য অংশীদার। করোনাকালীন অর্থনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল এই রেমিট্যান্স।
১৩ জুলাই ২০২৫ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীরা রেকর্ড ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এটি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২৬ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। ধারাবাহিকতায় ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জুলাই মাসের প্রথম ১২ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১ হাজার ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো গড় দৈনিক রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৮৯ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ছিল ৯৪৮ মিলিয়ন ডলার।
রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকায় বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এটি আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ১৬ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত দেশের মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ২৬ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্টপজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম–৬) পদ্ধতি অনুসারে ঐ তারিখে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ২৪ হাজার ৯৯৫ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের ভাষ্য, রেমিট্যান্সের রেকর্ড প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স হঠাৎ বৃদ্ধির পেছেনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রবাসীরা বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হয়েছেন। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। বা্যংকগুলোকে এলসি খোলতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে। এখন সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রবাসী আয়ের উর্ধ্বগতি এবং প্রত্যাশিত রপ্তানি আয়ের ফলে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা শক্তিশালী হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে মার্কিন ডলারের যে সংকট চলছিল, তা অনেকটা কেটে গেছে। ডলারের দাম নিয়ে যে অস্থিরতা ছিল, তাও কিছুটা কমে এসেছে।
দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো রেমিট্যান্স আসার শীর্ষস্থানে থাকলেও, গত আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে প্রবাসী আয় আসার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি–মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় এসেছে ১৪৪ দশমিক ৪৯ কোটি মার্কিন ডলার। যা মোট প্রবাসী আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ। ঐ সময়ে দেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছিল ৮০১ কোটি ডলার। এপ্রিল মাসে আসে ৩৩ কোটি ৭ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের পর জানুয়ারি–মার্চ মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই থেকে। উক্ত সময়ে দেশটি থেকে এসেছে প্রায় ১০৯ কোটি ডলার। একই প্রান্তিকে সৌদি আরব থেকে এসেছে প্রায় ১০৫ কোটি ডলার, যুক্তরাজ্য থেকে ৯৭ কোটি ডলার, মালয়েশিয়া থেকে ৬৩ কোটি ডলার, কুয়েত থেকে ৪৬ কোটি ডলার, ওমান থেকে ৪৪ কোটি, ইতালি থেকে ৪০ কোটি এবং কাতার থেকে ৩১ কোটি ডলার।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক রোমিট্যান্স প্রাপ্তিতে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৭ম অবস্থানে। রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে শীর্ষে রয়েছে ভারত। ২০২৪ সালে দেশটিতে প্রবাসী আয় এসেছে আনুমানিক ১২৯ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। এটি ছিল বৈশ্বিক রেমিট্যান্সের ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল মেক্সিকো। দেশটিতে ৬৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছে ঐ দেশের প্রবাসীরা। তৃতীয় স্থানে থাকা চীনা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২১ শতকের শুরু দিকে চীনের প্রবাসী আয় বৈশ্বিক রেমিট্যান্সের মাত্র ১ শতাংশের নিচে থাকলেও ২০১০ এর শুরুতে তা ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়ে ভারতের সমান হয়ে যায়। কিন্তু ২০১০ এর শেষ দিকে এটি ধীরে ধীরে ১০ শতাংশের নিচে নেমে যায়। ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবাসী আয় নিয়ে চতুর্থ স্থানে আছে ফিলিপাইন। রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে অষ্টম স্থানে থাকা দেশটির নাম মিসর। দেশটিতে প্রবাসী আয় আসে ২২ বিলিয়ন ডলার। নবম ও দশম অবস্থানে আছে যথাক্রমে গুয়েতামালা ও জার্মানি। উভয় দেশের প্রবাসীরা নিজ দেশে সাড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। উল্লেখ্য বছরে এশিয়ার মধ্যে প্রবাসী আয়কারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিপত্র অনুযায়ী, প্রবাসীদের জন্য আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা চালু, নিয়ম–কানুন সহজীকরণ ও নগদ প্রণোদনা বাড়ানোর মতো পদক্ষেপের ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষণীয়ভাবে বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া প্রবাসীদের সম্মাননা ও যাত্রার অভিজ্ঞতা আরও আরামদায়ক করতে গত নভেম্বরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চালু করা হয় ‘প্রবাসী লাউঞ্জ’। নীতিপত্রে আরও বলা হয়েছে, ক্রলিং পেগ এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবস্থা চালুর পর বৈধ ও অনানুষ্ঠানিক বাজারের বিনিময় হার ব্যবধান অনেকটা কমে এসেছে। এর ফলে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বেড়েছে এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল থেকেছে। তাছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ব্যুারো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমটি) দক্ষ কর্মীদের বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ লক্ষে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করছে বিএমইটি। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ–কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে বাজার চাহিদা সম্পন্ন দক্ষতা উন্নয়ন, সার্টিফিকেশন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
দক্ষ শ্রমবাজার সম্প্রসারণে আরও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে বিএমইটি, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন তহবিল এবং ইন্ডাস্ট্রি কম্পিটিটিভনেস অ্যান্ড ইনোভেশন প্রোগ্রামের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরিতে অব্যাহতভাবে কাজ করছে। মোদ্দাকথা দেশের নানামুখী সংকট উত্তরণে অর্থব্যবস্থার সমৃদ্ধিকরণ অতীব জরুরি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আশু পদক্ষেপ হিসেবে প্রয়োজনীয় পণ্যসমূহ পর্যাপ্ত আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সমস্যা যাতে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য প্রবাসী আয় আর্কষণে অধিকতর মনোযোগ আবশ্যক। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বৈধ পথে যাতে রেমিট্যান্স অধিক পরিমাণে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারে; তার জন্য নতুন নতুন প্রণোদনা–সুবিধাদির প্রায়োগিক পন্থা প্রবল প্রত্যাশিত।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী