বাড়ছে হাতির মৃত্যু ও হাতি দ্বারা মৃত্যু দুই-ই

জলদী অভয়ারণ্য রেঞ্জ

কল্যাণ বড়ুয়া, বাঁশখালী | শনিবার , ২১ জুন, ২০২৫ at ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতি অভয়ারণ্যের জলদী ও কালীপুর রেঞ্জের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও না কোথাও হাতির হামলায় ফসলি জমি, বাড়িঘর তছনছসহ নানাবিধ ঘটনা সংঘটিত হয়ে আসছে। অপরদিকে হাতির অভয়ারণ্যে জনবসতি নির্মাণ, পাহাড় নিধনসহ নানা কৌশলে হাতি নিধন, হাতি মেরে দাঁতশুড়সহ নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রির ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না হলে হাতির বিলুপ্তির আশক্সখা রয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন পরিবেশবিদ ও স্থানীয় পরিবেশবাদীরা। বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় বেশ কিছু আবাদি ফসলি জমি ও ক্ষেত রয়েছে। যেখানে চাষিরা গেলে নানা ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হন। তারা হাতির হামলা থেকে রক্ষা পেতে নানা কৌশল অবম্বলন করে পাহাড়ে চাষাবাদ করেন। বিগত দিনে বাঁশখালীর জলদী রেঞ্জের আওতায় জলদী, চাম্বল, নাপোড়া, পুঁইছড়ি বনবিট এলাকায় ও কালীপুর রেঞ্জের অধীনে কালীপুর, সাধনপুর, পুকুরিয়া, বৈলছড়ি ওপাইরাং এলাকায় অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি পূর্ব চাম্বল পাহাড়ি এলাকায় হাতির হামলায় নুরুল ইসলাম (৪৫), ২৮ ফেক্রয়ারি পূর্ব পুঁইছড়ি পাহাড়ি এলাকায় আবু ছিদ্দিকের (৪৫) মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই হাতির হামলায় দক্ষিণ সাধনপুর এলাকার মো. আবদুস ছবুর (৪২) নামে একজনের মৃত্যু হয়। ২০২৪ সালের ২ মে বৈলছড়ি ইউনিয়নের পুর্ব বৈলছড়ির মৃত তৈয়ব উলের ছেলে সিবাগাতুল্লাহ রিজভী (১৬) হাতির হামলায় প্রাণ হারায়।

অন্যদিকে চুনতি অভযারণ্য ও বাঁশখালীতে বিগত দিনে ২০টির অধিক হাতি মারা গেছে। স্থানীয় ও বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, কালীপুর রেঞ্জের অধীনে পাহাড়ি কালীপুর, সাধনপুর, পুকুরিয়া এলাকায় এবং জলদী রেঞ্জের আওতায় জলদী, চাম্বল, নাপোড়া, পুঁইছড়ি বনবিট এলাকায় ২০টির অধিক হাতির মৃত্যু হয়েছে। এসব হাতি বিদ্যুতের ফাঁদ, খাদ্যে বিষক্রিয়া, অসুস্থতাসহ নানা কারণে মৃত্যুর মুখে পড়েছে বলে বন বিভাগের তদন্ত ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান।

২০২৫ সালের ৬ মে পুঁইছড়ির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব পুঁইছড়ি বচিরা বাপের এলাকায় একটা মৃত হাতির বাচ্চা পাওয়া যায়। পরে তা চিকিৎসক ও বনবিভাগের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দাফন করা হয়। ২০২৫ সালের ৯ মে বাঁশখালীর জলদীর পাইরাং বিটের আওতায় মনুমার ঝিরির দমদমারমুখ এলাকায় একটা ক্ষতবিক্ষত দাঁত ও শুড়বিহীন হাতি উদ্ধার করা হয়। পরে তা পোস্টমর্টেম শেষে দাফন করা হয়। এ ঘটনার পর মামলা ও পক্ষেবিপক্ষে মানববন্ধন করা হলেও বর্তমানে কোনো ধরনের তৎপরতা নেই। ২৮ মার্চ জঙ্গল নাপোড়ায় কাদায় আটকে যাওয়ার পর মারা যায় একটি হাতি। জলদী অভয়ারণ্য রেঞ্জে ২০২৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চাম্বল বিটের জঙ্গল চাম্বল মৌজার মিতাইঝিরি গুন্ডার টেক এলাকায় একটি বন্য হাতি পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। দুই দিন পর চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যায় হাতিটি। ২০২৩ সালের ৮ জুলাই চাম্বলের দুইল্লাঝিরি এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে একটি এবং ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর চাম্বল এলাকার পূর্ব চাম্বলে ধানক্ষেত থেকে একটি হাতির মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। অপরদিকে ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত কালীপুর রেঞ্জ আওতায় ১১টি হাতি মারা গেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১৮ জুন আনুমানিক ২৪ বছর বয়সী মাদি হাতি মারা যায় খাদ্য বিষক্রিয়ায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ১৯৮০ সালে দেশে হাতি ছিল ৩৮০টি। ২০০০ সালের জরিপে তা কমে দাঁড়ায় ২৩৯ এ। ২০১৬ সালের জরিপে হাতি ছিল ২৬৮টি। বিগত দিনে চুনতি অভয়ারণ্য ও বাঁশখালীতে প্রায় একশ হাতি রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে। মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে হাতির সংখ্যা এভাবে দিন দিন কমছে বলে জানায় বিশেষজ্ঞ মহল। এদিকে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১০২টি বন্য হাতি মারা গেছে বিগত সময়ে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ১৬টি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও ৫টি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ৫৩টি হাতি বার্ধক্যজনিত জটিলতা বা হৃদরোগের মতো প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছে। ১৭টি হাতি মারা গেছে দুর্ঘটনায় পড়ে। বাকিগুলোর মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করা না হলেও এসব হাতি হত্যায় ঘটনায় মাত্র ১৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া এ সময়ে অঞ্চলে মানুষহাতির সংঘাতে ৪৪ জন মানুষও মারা গেছে।

স্থানীয় বন অভ্যন্তরে বসবাসকারী এবং সাধারণ পরিবেশ কর্মীরা জানান, খাদ্যের অভাবে হাতি প্রায় সময় লোকালয়ে চলে আসে। তাতে জনগণ নানাভাবে তাদের উপর হামলা করে এবং ফাঁদ পেতে হত্যা করছে। যা পরিবেশের জন্য চরম হুমকি। হাতির খাদ্য নিশ্চিত করে তারা যাতে লোকালয়ে না আসে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি যারা ফাঁদ পেতে হাতি হত্যার মত ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া বনের অভ্যন্তরে যারা অবৈধভাবে বসবাস করে কিংবা পাহাড় ও মাটি কেটে সাবাড় করে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

জলদী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, হাতিকে সুরক্ষা করা বনবিভাগের নিয়মিত দায়িত্ব। বর্তমান সরকার হাতির আবাসস্থল নিরাপদ করা, খাদ্য বৃদ্ধি করা, বনাঞ্চলের ভিতর জলাধার তৈরি করা, হাতির করিডোরগুলো বাধামুক্ত করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তাছাড়া হাতি সুরক্ষায় বন বিভাগের সাথে স্থানীয় ইআরটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। হাতি সুরক্ষায় বনবিভাগের আরও প্রশিক্ষিত জনবল ও লজিস্টিক বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য বলেন, চুনতি অভয়ারণ্য ঘিরে হাতির নিরাপদ আবাস গড়ার লক্ষে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তা বাস্তবায়ন হলে হাতি সংরক্ষণ ও নিরাপদ রাখার জন্য নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, হাতিকে নিরাপদে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যেতে পাঁচটি এলিফ্যান্ট রেসকিউ টিম গঠন করা হয়েছে। হাতির দ্বারা কারও সম্পদের ক্ষতি হলে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতি পূরণ, গুরুতর আহত হলে ১ লাখ টাকা এবং মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৩ লাখ টাকা পাবে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুইটি চোরাই মোটর সাইকেলসহ দুজন গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধনিজ ঘরে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু