দুই দশক আগেও দেশে ডায়াবেটিস ছিল স্বল্প পরিচিত একটি রোগ। আজকে সেটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। শহর অঞ্চল ছাড়া গ্রামেও ডায়াবেটিস রোগী আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। শহর ও গ্রামের হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর চাপ। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং ওয়ার্ডে সেবা নিতে প্রতিদিন ভিড় করছেন ডায়াবেটিস রোগীরা। চিকিৎসকরা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ ডায়াবেটিস আক্রান্ত অর্ধেক লোক জানেই না, তারা এ রোগে আক্রান্ত। এমন পরিস্থিতিতে ‘ঝুঁকি এবং জটিলতা জানুন, উপযুক্ত সাড়া দিন’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার পালিত হবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।
জানা গেছে, বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি। ২০৩০ সালের মধ্যে হয়তো সেটি ৬০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে ৭০ দশকে ডায়াবেটিসের প্রবণতা ছিল মাত্র ২ শতাংশের মতো। সেটি আজ কয়েক গুণ বেড়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলেও ডায়াবেটিসের সামগ্রিক প্রবণতা ৫ থেকে ৮ শতাংশের মতো। এছাড়া গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার আমাদের দেশে উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে ৭৫০ রোগী ভর্তি ছিলেন। এছাড়া টাইপ–১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ভর্তি সংখ্যা ছিল ২২ জন এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ৫০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। অপরদিকে গত এক বছরে এন্ডোক্রাইনোলজি বহির্বিভাগে টাইপ–২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ৯ হাজার রোগী সেবা নিয়েছেন। এছাড়া টাইপ–১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৩৯ জন এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২০০ রোগী সেবা নিয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানান, রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিদিন ধরে বেশি থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের নানা প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও ডায়াবেটিস হয়। সব বয়সীদের এ রোগ হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। বলা যায়, এটি আজীবনের রোগ। ঘন ঘন প্রশ্রাব, অত্যধিক পিপাসা লাগা, বেশি ক্ষুধা পাওয়া, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে ছিঁড়ে গেলে ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি না শুকানোই হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল ও মোটা শস্যদানা জাতীয় খাবার খেতে হবে। এতে টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া ডায়াবেটিসের বোঝা কমানোর জন্য অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। সুষম খাবার টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনে। তবে বর্তমানে হাই ক্যালরি ও অপুষ্টিকর সস্তা খাবার বিশেষত ফাস্টফুড গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে টাইপ–২ ডায়াবেটিস। এছাড়া স্থূলতা, কায়িক পরিশ্রম না করাও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। তবে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগে বর্তমানে একজন সহযোগী অধ্যাপক, দুজন সহকারী অধ্যাপক এবং একজন সহকারী রেজিস্ট্রার কর্মরত আছেন। অন্যদিকে রেজিস্ট্রারের পদ সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া ওয়ার্ডে নেই কোনো ইনডোর মেডিকেল অফিসার। বিভিন্ন বিভাগ থেকে আগত স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী এবং অনারারি চিকিৎসক দিয়ে ওয়ার্ড চালাতে হচ্ছে। এছাড়া একমাত্র সহকারী রেজিস্ট্রারকে ওয়ার্ড এবং বহির্বিভাগ দুটোই সামলাতে হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওয়ার্ডের জন্য ৪ জন মেডিকেল অফিসার এবং বহির্বিভাগের জন্য ৪ জন মেডিকেল অফিসার পদায়ন করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এন্ডোক্রাইনোলজি ওয়ার্ডে মোট শয্যা আছে ১৬টি। এর মধ্যে ৮টি পুরুষ এবং ৮টি মহিলার জন্য সংরক্ষিত। তবে বর্তমানে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য হরমোন রোগ বাড়ার কারণে নির্ধারিত শয্যার বাইরে দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকছে। শয্যার অতিরিক্ত রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ওয়ার্ডে নেই কোনো এইচডিইউ বেড। জটিল রোগীদের মেডিসিন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এতে রোগীদের চিকিৎসা ও ফলোআপ করতেও ডায়াবেটিস চিকিৎসকদের মেডিসিন ওয়ার্ডে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। তাই ওয়ার্ডে অন্তত চারটি এইচডিইউ বেড স্থাপনসহ মোট শয্যা ১৬ থেকে ৩২–এ উন্নীত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
চমেক হাসপাতাল এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার আজাদীকে বলেন, দিন দিন ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মূলত ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করাটাই আমাদের লক্ষ্য। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, প্রতি দুজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মধ্যে একজন জানতেই পারছেন না যে ডায়াবেটিস রোগ হয়েছে। ডায়াবেটিস রোগ হলে শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সবার সচেতন হওয়া দরকার। আরেকটি বিষয়, ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে অনেকের ইনসুলিন নেওয়ার প্রতি এক ধরনের অনীহা আছে। আসলে ইনসুলিনের ক্ষতিকারক কোনো প্রভাব নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ইনসুলিন নেওয়া উচিত।