আমাদের বাঙালি সমাজে বৈশাখ আসে নবআনন্দের জোয়ার নিয়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও এসেছিলেন এই বৈশাখে, তাঁর রচনার ডালিও তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন বৈশাখের প্রেম, প্রকৃতি আর মানুষের জয়গানে। বৈশাখ তার নামের জন্য বিশাখা নক্ষত্রের কাছে ঋণী। পুরান মতে, বিশাখা নক্ষত্র চন্দ্রের সপ্তবিংশ পত্নীর অন্যতম। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের অবস্থানের সাথে বিভিন্ন নক্ষত্রের অবস্থানের সম্পর্ক দেখে মাস ভাগ করে সেই মাসগুলোর নাম রেখেছিলেন আর এই বিশাখা হল উষ্ণতার সূচক। বাংলাদেশে আমরা বৈশাখের যে রূপ দেখি, কাশ্মীরে তা নেই এবং উত্তর প্রদেশে তার যে রূপ, রাজস্থানে সে রকমটি নয়। অন্য কথায় বৈশাখ কোথাও শান্ত, স্নিগ্ধ আবার কোথাও রুদ্র, খরতাপময়, যেমনটি দেখি বাংলাদেশে কিংবা তার প্রত্যন্ত এলাকায় বা মরুভূমিতে।
বাংলা মাসগুলির নামের অর্থ বিচার করলে অগ্রহায়ণকে বৎসরের প্রথম মাস বলে ধরা উচিৎ। কিন্তু প্রচলিত নিয়ম অনুসারে বৈশাখই বৎসরের প্রথম মাস। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, বাংলা সন প্রবর্তনের সময় বৈশাখ মাসটি ছিলো বলে সেটিকেই বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে প্রচলিত কোন কোন সনে অগ্রহায়ণ থেকে বৎসর শুরু করা হতো, যদিও সে সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায়না কিংবা তেমন কোনো সন থেকে থাকলে বাংলা বৎসর শুরু করার ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সাধন করা হয়েছিলো, তাও বলতে হবে। আর এ ধরনের পরিবর্তনের মাধ্যমেই এ সৌর সনটি বৈশাখকে নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আকার ধারণ করতে পেরেছে । কাজেই এ সনটি যে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করছে, এ কথা বলা যায়।
বৈশাখী সংস্কৃতির বিভিন্ন সামাজিকতা এখনো আমরা দেখতে পাই। তার মধ্যে তিন ধরনের অনুষ্ঠানের প্রচলন এখনো আছে। যেমন ১. আমানিঃ চৈত্র মাসের শেষ দিনে গৃহিণীরা এক হাঁড়ি জলে স্বল্প পরিমান অপরিপক্ক আম এবং চাল ছেড়ে দিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখার পর তাতে কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন এবং পরদিন ঘরের সবাই সেই ভিজা চাল খায় এবং আমের ডালের জল সারাঘরে ছিটাতে থাকেন যাতে সংসারে সুখশান্তি বিরাজ করে। ২. গম্ভীরাঃ রাজশাহীতে লোকগীতি ও লোক নৃত্যের এই অনুষ্ঠান ব্যাপক জনপ্রিয় এবং এটি একটি স্থানীয় অনুষ্ঠান, সারা বৈশাখ মাস জুড়ে ঘটা করে না হলেও নীরবে গম্ভীরা পরিবেশিত হয়। ৩. বলীখেলার মেলা ঃ এটি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত মেলা। প্রতিবছর ১২ বৈশাখ লালদিঘীর পাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই মেলার আয়োজন চলে। এতে এ অঞ্চলের বিখ্যাত কুস্তিগিরেরা অংশ নেয়। জব্বারের বলীখেলা নামে এই মেলা পরিচিত। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই মেলার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। গ্রাম বাংলায় নাড়ু, মুড়ি, মোয়া, আটকড়াই এসব খাওয়ার রীতি এখনো প্রচলিত। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা আজও এই বৈশাখে তাদের উৎসব পালন করে চলেছে। বৈশাখী এই সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব পরিচয় বহন করে নিঃসন্দেহে।
বৈশাখ মূলত আমাদের জাতীয় জীবনকে এক উৎসবের আমেজে ভরিয়ে তোলে। উৎসবের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ , সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ বাঙালীর জীবনে বৈশাখী মেলার একটি যোগসূত্র তৈরি হয়ে উৎসবের শক্তি বৃদ্ধি পায়। মেলায় মানুষের বৃহৎ সম্মীলনে তাদের মধ্যে অতি নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয় এবং লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সমন্বিত অন্তরঙ্গ পরিচয় এই মেলাতেই সার্থকভাবে প্রকাশিত হয়। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার এক পরিসংখ্যানমতে, আমাদের দেশে বৈশাখ মাসে অন্তত দুশোটি মেলার আয়োজন করা হয়। এই বৈশাখী মেলা বাঙালী ঐতিহ্যের স্বতঃস্ফূর্ত স্মারক। বর্তমানে বৈশাখী মেলার লৌকিক ধারা এসে মিশেছে নাগরিক প্রয়াসের সঙ্গে। গ্রামীণ বৈশাখী মেলায় ঘর গেরস্থালির দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী, নারীর রূপসজ্জা–অংগাভরনের বস্তু থেকে শুরু করে শিশু কিশোরের আনন্দ ক্রীড়ার উপকরণ ও রসনা তৃপ্তির খাদ্য সামগ্রীর সমারোহ থাকে। বৈশাখী মেলা লোকধারার প্রেরণা নিয়ে নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় নগরজীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে বলা যায়। এর সাথে মানুষের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াও জড়িত। বাঙালী সংস্কৃতির মূলধারা অন্বেষণে এবং বাঙালী জাতিসত্তা জাগ্রত করার মানসে এই বৈশাখী মেলা প্রেরণা ও পাথেয় হিসেবে বিবেচিত।
রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে দেখেছেন ফেলে আসা অতীতের সমস্ত তিক্ততা আর গ্লানিময় ঘটনা ভুলে গিয়ে বছরের প্রথম মাসে নতুন করে শুরু করার প্রয়াস হিসেবে। সেইসাথে কবি চেয়েছেন জরার অবসানে অগ্নিস্নানে এই পৃথিবীর শুচিতা। অশ্রুময় অতীত ভুলে গিয়ে সদাহাস্য এক ভবিষ্যতের প্রত্যাশা ছিল কবির। তাই কবি অগ্রসরমান বাঙালীর পথকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেতনায় বৈশাখকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বৈশাখ’ কবিতায় বৈশাখকে দেখেছেন রুদ্র বৈশাখের ভাবনায়। কবিতার প্রথমেই তিনি বৈশাখকে উল্লেখ করেছেন ভৈরব বলে এক ভয়ংকর রূপে, যেখানে তিনি ধূলায় ধূসর বিষান ভয়ালরূপে বৈশাখকে রূপায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বৈশাখের সামনে যেন জ্বলছে চিতাগ্নিশিখা ,যেখানে বিগত বছরের সমস্ত পরিত্যক্ত মৃতস্তুপ জ্বলছে ভস্মসার হয়ে। আবার পরক্ষণে তিনি বৈশাখের শান্তিপাঠ করেছেন যেখানে বৈশাখকে আবাহন করেছেন বৈরাগী হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেবার। বিদ্রোহী কবি নজরুলের সেই কবিতা‘ওই নূতনের কেতন ওড়ে, কালবোশেখির ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ যেখানে বৈশাখের রুদ্ররূপ কিংবা ঝড়ের তান্ডবের অবয়ব ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি এক নতুন দিনের প্রত্যাশায় কবি পতাকা ওড়ানোর প্রয়াস পেয়েছেন।
বৈশাখ যুগে যুগে বাঙালির কাছে হাজির হয়েছে নব নব রূপে। বাঙালি এই বৈশাখকে নানা সময় নানাভাবে গ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়পর্বে রক্তস্নাত সেইদিনে বৈশাখএসেছিলো এক রুদ্র চেতনায়, অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে। তাইতো কবি লেখেন, ‘এবার নববর্ষে দেয়া তোর বৈশাখী জামা/ ওদের রক্তে ভিজিয়ে দে তোর পায়ে এনে / বৈশাখের রুদ্র জামা আমাকে পরিয়ে দে মা (মুস্তফা আনোয়ার / বৈশাখের রুদ্র জামা)। এভাবে দেখা যায়, বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের উৎসধারায় বৈশাখ সবসময় জড়িয়ে ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে ।
লোকসংস্কৃতির বহু নিদর্শন আমাদের দেশে রয়েছে। শতাব্দী ধরে চলে আসা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রবহমানতায় আমরা সমৃদ্ধ করেছি নিজেদের। এ জন্যে বৈশাখের কাছে আমরা ঋণী, কারণ বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে এটি বাঙালি সাংস্কৃতিক ধারায় আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এ তো বাঙালির বৈশাখ, চির নতুনের দিগন্ত উন্মোচনের মাস।
লেখক : প্রাবন্ধিক, বাচিকশিল্পী