অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম। ২০০৪ সালের বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকায় ১৮ নম্বরে স্থান করে নিয়েছেন অতীশ দীপঙ্কর। বাঙালির গৌরব অতীশ দীপঙ্কর পাল সাম্রাজ্যের দশম ও একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত। বিক্রমপুর বজ্রযোগীনি বর্তমানে মুন্সিগঞ্জের রামপাল ইউনিয়নের রাজপরিবারে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম। তাঁর বাবা রাজা কল্যাণশ্রী ও মাতা রাণী শ্রীপ্রভা। তাঁর গৃহীনাম চন্দ্রগর্ভ। তিনি একাধারে ধর্মগুরু, শিক্ষক, পণ্ডিত, লেখক, দার্শনিক, বিতার্কিক এবং বাগ্মী।
১৯৮৩ সালে অতীশ দীপঙ্করের বজ্রযোগিনী গ্রামের বিক্রমপুরে তাঁর জন্মের হাজার বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকা ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ শুদ্ধানন্দ মহাথেরো (প্রয়াত) অতীশ দীপঙ্করের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে রিলিক্স স্তুপা এবং অতীশ দীপঙ্কর মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারের পক্ষ থেকে অতীশ দীপঙ্কর লাইব্রেরি কাম মিউজিয়াম নির্মাণ করা হয়। ঢাকার উত্তরায় এই গুণীর নামে ‘অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ রয়েছে।
জীবনের প্রথমভাগে তান্ত্রিক শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গুহ্যজ্ঞানর্বজ’ উপাধি লাভ করেন। ৩১ বছর বয়সে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য সুবর্ণদ্বীপে আচার্য ধর্মকীর্তির নিকট গমন করেন। সেখানে ১২ বছর অধ্যয়নের পর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। পরবর্তীতে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন।
অতীশ দীপঙ্করের জীবনী থেকে জানা যায়, সুবর্ণদ্বীপ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মহাবোধিবিহারের অবস্থানকালে ধর্মীয় বিতর্কে তিনবার তীর্থিকদের পরাজিত করে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।
পরবর্তীতে রাজা নয়পালের অনুরোধে বিক্রমশীল বিহারের অধ্যক্ষপদ গ্রহণ করেন। ঐসময় কার্ণ্যরাজ মগধ আক্রমণ করলে নয়পালের সৈন্যবাহিনী প্রথমে পরাজিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে মগধরাজ জয়লাভ করেন। এরপর শক্রপক্ষ শান্তির আবেদন জানালে অতীশ দীপঙ্করের একান্ত প্রচেষ্টার কারণে উভয় রাজ্যের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়।
মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহাসাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের নিকট দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর নতুন নামকরণ হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। আচার্যদের নিকট শিক্ষালাভ করে শূন্য থেকে জগতের উৎপত্তি–এ তত্ত্ব (শূন্যবাদ) প্রচার করেন। বিক্রমশীলাসহ ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারে তিনি ১৫ বছর অধ্যাপনা করেন । শুধুমাত্র তান্ত্রিক শিক্ষায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি বৌদ্ধধর্মের হীনযান, মহাযান ও বজ্রযান শাখায় পূর্ণজ্ঞান আয়ত্ত করেন।
তিব্বত থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত দার্শনিক অতীশ দীপঙ্কর তার প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন। ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে ৫৯ বছর বয়সে তিব্বতের রাজা কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে তিব্বতে তিনি রাজকীয় সম্মান লাভ করেন। তিব্বতে গিয়ে ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি চিকিৎসা ও কারিগরিবিদ্যা বিষয়ে তিব্বতি ভাষায় বই রচনা করেন বলে সেখানে তিনি সম্মানসূচক ‘অতীশ’ উপাধি লাভ করেন।
বাহুবলে নয় কিংবা কোনো ভয় দেখিয়েও নয়, শুধুমাত্র প্রেম, করুণা এবং মৈত্রীর মাধ্যমে তিনি তিব্বতের সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। তিব্বতে তিনি গবেষণার পাশাপাশি বহু প্রাচীণ সংস্কৃত পুঁথি আবিস্কার করেন যেগুলোর প্রতিলিপি তৈরি করে তিনি এই দেশে পাঠান। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান প্রায় ২০০ এর অধিক গ্রন্থ রচনা করেন বলে জানা যায়।
অল্প বয়সে তিনি সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখেন এবং ১০ বছর বয়সে বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য শাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারার ক্ষমতা অর্জন করেন। ১২ বছর বয়সে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তন্ত্রশিক্ষা করেন।
১০১১ খ্রিস্টাব্দে মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে গমন করেন। ৪৩ বছর বয়সে মগধে ফিরে আসেন। তাঁর বাগ্মিতা, যুক্তি ও পান্ডিত্যের কাছে মগধের প্রথম শ্রেণির পন্ডিতরাও বিতর্কে পরাজিত হতেন। এভাবে তিনি একজন পন্ডিতের স্বীকৃতি লাভ করেন।
তিব্বতের ঐতিহাসিকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ গোই লোচারা শোননু পালের মতে, অতীশ অতীশ দীপঙ্কর তাঁর শেষ জীবনে অর্থাৎ ১০৪২ থেকে ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিব্বতে ছিলেন। এই জ্ঞানতাপস ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে লাসা নগরের কাছে চে–থঙের দ্রোলমা লাখাং তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।