বাঙালি রমণীর মর্যাদায় সৌদি সরকারের অনন্য নজির

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | বুধবার , ১০ মার্চ, ২০২১ at ৮:২০ পূর্বাহ্ণ

কেসাস বা মৃত্যুদণ্ড পবিত্র আল্‌-কোরআনের ফরজ বিধান। অন্যান্য ফরজ বিধানের মত কেসাসও একটি অন্যতম ফরজ বিধান। এ বিধানকে অস্বীকার করলে একজন মুসলমান ব্যক্তির ঈমান থাকবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কেসাস নামক বিধানটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে হাজারো সাহাবি মৃত্যুর পেয়ালা পান করতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। সম্প্রতি সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মী আবিরন বেগম হত্যা মামলায় সেখানে চাকরিদাতা গৃহকত্রী আয়েশা আল্‌-জিজানিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তার সঙ্গে ঔ বাসার গৃহকর্তা বাসেম ছালেমকে তিন বছর দু’ মাস কারাদণ্ড ও পঞ্চাশ হাজার সৌদি রিয়াল জরিমানা করা হয়েছে। এ দম্পতির ছেলে ওয়ালিদ বাসেম ছালেমকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে সাত মাস রাখার রায় দিয়েছেন আদালত। রিয়াদের ক্রিমিনাল কোর্টের ছয় নম্বর আদালত এ ঐতিহাসিক রায় দেয়। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার এটি একটি ঐতিহাসিক নজির, যা সেই খোলাফায়ে রাশেদিনের শূন্যতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বিশাল সৃষ্টিলোকের একচ্ছত্র অধিপতি মহান রাব্বুল আ’লামিন তাঁর মহা সত্যগ্রন্থে বলেছেন, ‘সেখানে আমি তাদের জন্যে (এই ফৌজদারী) বিধান নাযিল করেছিলাম যে, প্রত্যেক জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত, (শাস্তি প্রয়োগের সময় এ শারীরিক) যখমটাই কিন্তু আসল দণ্ড, অবশ্য কেউ যদি এই দন্ড মাফ করে দেয়, তাহলে তা তার জন্যে কাফ্‌ফারা হবে ; আর যারা আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সলা করে না, তারাই হচ্ছে জালেম’-সূরা মায়েদা-৪৫। হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের জন্যে নরহত্যার (ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে) ‘কেসাস’ (প্রয়োগকে) ফরয করে দেয়া হয়েছে (এবং তা হচ্ছে) স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি (দণ্ডাজ্ঞা পাবে), দাসের বদলে (পাবে) দাস, নারীর বদলে নারীর ওপর (দণ্ড প্রযোজ্য হবে), অবশ্য যে হত্যাকারীকে (যাকে হত্যা করা হয়েছে তার পরিবারের লোকেরা কিংবা) তার ভাইর পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দেয়া হয় তার ক্ষেত্রে কোনো ন্যায়ানুগ পন্থা অনুসরণ (করে তা নিষ্পত্তি) করতে হবে, এটা তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে দণ্ড হ্রাস (করার একটা উপায়) ও তাঁর একটি অনুগ্রহ মাত্র; এরপর যদি কেউ বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তার জন্যে কঠোর শাস্তি রয়েছে’-সূরা বাকারা-১৭৮। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুসলিমগণ ! প্রতিশোধ গ্রহণের সময় ন্যায় পন্থা অবলম্বন করবে। স্বাধীন ব্যক্তির পরিবর্তে স্বাধীন ব্যক্তি, দাসের পরিবর্তে দাস এবং নারীর পরিবর্তে নারীকে হত্যা করবে। এ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করবে না। যেমন : সীমালঙ্ঘন করেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা। তারা আল্লাহর নির্দেশ পরিবর্তন করে ফেলেছিল’। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ এই যে, অজ্ঞতার যুগে বানু নাযীর ও বানু কুরাইযা নামক ইয়াহুদীদের দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ বানু নাযীর জয়যুক্ত হয়। অতঃপর তাদের মধ্যে এই প্রথা চালু হয় যে, যখন বানু নাযীরের কোন লোক বানু কুরাইযার কোন লোককে হত্যা করত তখন প্রতিশোধরূপে বানু নাযীরের ঐ লোকটিকে হত্যা করা হত না। বরং রক্তপণ হিসাবে তার নিকট হতে এক ওয়াসাক (প্রায় ১৮০ কেজি) খেজুর আদায় করা হত। আর যখন বানু কুরাইযার কোন লোক বানু নাযীরের কোন লোককে হত্যা করত তখন প্রতিশোধ রূপে তাকেও হত্যা করা হত এবং রক্তপণ গ্রহণ করা হলে দ্বিগুণ অর্থাৎ দুই ওয়াসাক খেজুর গ্রহণ করা হত। সুতরাং মহান আল্লাহ এই আয়াতের মাধ্যমে অজ্ঞতা যুগের ঐ জঘন্য প্রথাকে উঠিয়ে দিয়ে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠিত করার নির্দেশ দেন। ‘কাফিরকে হত্যা করার জন্যে মুসলিমকে (হত্যাকারী) হত্যা করা যাবেনা’-(বুখারী ১১১), এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত পোষণ করার কিংবা এর বিপরীত বর্ণনার কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায়না। অবশ্য আবূ হানিফা উক্ত সূরা মায়িদার ৪৫ নং আয়াতের বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী এ মত পোষণ করতেন যে, কাফিরকে হত্যা করার জন্য হত্যাকারী মুসলিমকেও কতল করা যাবে। আনাস ইব্‌ন মালিকের (রা.) ফুফু রাবী (রা.) এক দাসীর একটি দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। তখন জনগণ তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু সে ক্ষমা করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গমন করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন ঃ ‘কিসাস নেয়া হবে’। তখন আনাস ইব্‌ন মালিক (রা.) বলেন ঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ! তাঁর কি দাঁত ভেঙ্গে দেয়া হবে?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন ঃ ‘হ্যাঁ ! হে আনাস ! আল্লাহর কিতাবে কিসাসের হুকুম বিদ্যমান রয়েছে’। তখন আনাস (রা.) বললেন ঃ না, না, যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ ! তাঁর দাঁত কখনও ভেঙ্গে ফেলা হবে না। বস্তুতঃ হলও তাই। দাসীটির কওম সম্মত হয়ে গেল এবং কিসাস ছেড়ে দিল, এমন কি সম্পূর্ণরুপে ক্ষমা করে দিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ঃ ‘অবশ্যই আল্লাহর কতক বান্দা এমন রয়েছে যে, তারা আল্লাহর উপর কোন কিছুর শপথ করলে তিনি তা পুরা করেন’। আল্লাহতায়ালা বলেন ঃ যখমের পরিবর্তে যখম। ইব্‌ন আব্বাস (রা.) বলেন যে, প্রাণের বদলে প্রাণ হত্যা করা হবে, কেহ কারও চোখ উঠিয়ে নিলে তারও চোখ উঠিয়ে নেয়া হবে, কেহ কারও নাক কেটে নিলে তারও নাক কেটে নেয়া হবে, কেহ কারও দাঁত ভেঙ্গে দিলে তারও দাঁত ভেঙ্গে দেয়া হবে এবং যখমেরও বদলা নেয়া হবে (তাবারী ১০/৩৬০)। এ ব্যাপারে আযাদ মুসলিম সবাই সমান। নারী ও পুরুষের একই হুকুম, যখন তারা ইচ্ছাপূর্বক এ কাজ করবে। তাতে গোলামেরাও পরস্পরের মধ্যে সমান। তাদের পুরুষ লোকেরাও সমান এবং স্ত্রীলোকেরাও সমান। বাঙালি রমণী হত্যার বিপরীতে যে রায় রিয়াদের আদালত দিয়েছেন তা একটি ব্যতিক্রমী নজির হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ বিধান আল্লাহর জমিনের প্রতিটি ইঞ্চিতে বাস্তাবায়ন চাই। তবেই হত্যাকাণ্ডের প্রসারতা অনেকাংশে বন্ধ হতে বাধ্য। অন্যায় হত্যাকান্ডের সঠিক বিচার না হওয়ার কারণে হত্যাকারীরা অধিকতর হত্যাকান্ডে উৎসাহিত হয়ে থাকে। আর দুঃখীনি মা হারান তার প্রিয় বৎসকে, হতভাগীনি স্ত্রী হারান তার প্রিয়তম স্বামীকে। দেড় হাজার বছর আগে মহান রাব্বুল আ’লামিন সৃষ্টিকূলের শ্রেষ্ঠ মানুষ, মানবতার মহান মুক্তিদূত হযরত মোহামমদ (সা.) এর উপর যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই নিহিত হয়েছে মানব সমাজের অধিকতর কল্যাণ।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅর্থাভাবে-বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু নয়
পরবর্তী নিবন্ধনারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ