বাংলাদেশের তাঁত শিল্প ও তাঁত শিল্পীরা আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। এই শিল্পের সাথে জড়িত আছে এদেশের সংস্কৃতি। বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ক্রম–বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সাত শতকের চৈনিক বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী হিউয়েন–সাং ও তের শতকের মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা’র ভ্রমণ কাহিনীতে এবং উনিশ শতকের বিখ্যাত গবেষক জেম্স ওয়াইজ এর গবেষণায় বাংলার বস্ত্র ও তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। তাদের ঐতিহাসিক বিবরণ বাংলার লোক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ব্যাপক সহায়তা করে। এই দিকগুলো বিবেচনা করে বলা যায় এই বাংলার তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। এটি আমাদের হাজার বছরের কৃষ্টির পরিচয় বহন করে। সুলতানি ও মোগল যুগের উত্তরাধিকারী হিসাবে এখানকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। এক সময় এদের পূর্বপুরুষরাই মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্র তৈরি করত। দিল্লির মোগল দরবার থেকে বৃটেনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এই মসলিনের কদর ছিল বেশ। জগদ্বিখ্যাত মসলিন সারা বিশ্বে বাংলার গৌরব বৃদ্ধি করেছিল। এখনো দেশের তাঁত শিল্পীদের তৈরি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক জামদানী, রাজশাহীর রেশমী বা সিল্ক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, কুমিল্লার খাদি বা খদ্দর, সিরাজগঞ্জের লুঙ্গী ও গামছা, ঢাকার মিরপুরের বেনারসি, সিলেট ও মৌলভীবাজারের মনিপুরি তাতঁ ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির তাতেঁর রয়েছে বিশ্ব ব্যাপী চাহিদা ও কদর।
প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তি অনুসারে তাঁত শিল্পের ইতিহাস সঠিক বলা মুশকিল ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হলো আদি তাঁতি। এরা আদিকাল থেকে প্রধানত তাঁত বুনে আসছে। এ পোশাক শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষ তন্তুবায় বা তাঁতি নামে পরিচিত। এরা প্রধানত যাযাবর শ্রেণীর অন্তর্গত ছিল। প্রথমে এরা সিন্ধু উপত্যকার অববাহিকায় বসবাস করত, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা সে স্থান পরিত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করে। সেখানকার আবহাওয়ায় শাড়ির মান ভালো হচ্ছে না দেখে তারা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়ে পড়েন, চলে আসেন বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে। সেখানেও আবহাওয়া অনেকাংশে প্রতিকূল দেখে বসাকরা দু’দলে ভাগ হয়ে একদল চলে আসে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, অন্যদল ঢাকার ধামরাইয়ে। তবে এদের কিছু অংশ সিল্কের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজশাহীতেই থেকে যায়। ধামরাইয়ে কাজ শুরু করতে না করতেই বসাকরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব–সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভাগ হয়ে অনেক বসাক চলে যান প্রতিবেশী দেশের চোহাট্টা অঞ্চলে। এর পর থেকে বসাক তাঁতিরা চৌহাট্টা ও ধামরাইয়া এ দু’গ্রুপে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েন। আরো কথিত আছে হিন্দু তাঁতীদের মৌলিক উপাধিই ছিল বসাক আর মুসলিম কারিগর বা তাঁতীদেরকে বলা হতো জোলা। এক কালে এদেশের বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে বসাক শ্রেণীর বসবাস ছিলো। তারা বসাক সমিতির মাধ্যমে কাপড়ের মান নিয়ন্ত্রণ করতেন ও অনভিজ্ঞ তাঁতিদেরকে প্রশিক্ষণ দিতেন। বসাক ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁত শিল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। তারা বসাক তাঁতিদের মতোই দক্ষ হয়ে উঠেন। রাজশাহী, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ আরও অন্যান্য অঞ্চলেও বসাক, যূগী বা দেবনাধসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তাতিঁরা তাতঁ শিল্পের প্রসার ঘটায়। বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ তারা তাঁত বুনে আসছেন।
তাছাড়া তাঁত শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানা যায় যে তাঁত শিল্প মনিপুরীরা অনেক আদিকাল থেকে এই বস্ত্র তৈরি করে আসছে। মনিপুরীদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল বা মেশিন প্রধানত তিন প্রকার যেমন, কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং। এই তাঁতগুলো দিয়ে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, শাড়ি, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারী, ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে তাঁত শিল্পে নির্মিত সামগ্রী বাঙালি সমাজে নন্দিত ও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নকশা করা ১২ হাত মনিপুরী শাড়ি, নকশি ওড়না, মনোহারী ডিজাইনের শীতের চাদর বাঙালি মহিলাদের সৌখিন পরিধেয়।
বংশ পরম্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে বয়ন উৎকর্ষতায় তাঁতিরা সৃষ্টি করেছিল এক অনন্য স্থান। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার সর্ববৃহৎ কাপড়ের হাট ‘‘নরসিন্ধির শেখের মাঠ’’ গ্রামে গড়ে উঠেছিল যা ‘‘বাবুর হাট’’ নামে পরিচিত ছিল। অবিভক্ত বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে হস্ত চালিত তাঁতে কাপড় বোনা হলেও বাণিজ্যিকভাবে শেখের চরের কাপড়ের সমকক্ষ কেউ ছিল না। সুলতানি ও মোঘল যুগের উত্তরাধিকারী হিসাবে এখানকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁদের রং, নকশা ও বুনন পদ্ধতি অন্যান্য সমস্ত এলাকা থেকে আলাদা। এক সময় এদের পূর্বপুরুষরাই জগদ্বিখ্যাত মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্র তৈরি করে সারা বিশ্বে বাংলা তথা ভারতবর্ষের গৌরব বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে অসম কর গ্রহণ, তাঁতের ওপর আরোপিত নানা বিধি নিষেধ এবং ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের জন্য ভারতীয় তাঁত শিল্পের সর্বনাশ ঘটে। এরপর স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ও এই শিল্পের বিকাশের জন্য বিশেষ কোনো ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। বাজার অর্থনীতির সম্প্রসারণ এই অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফলে নানা ডিজাইনের, নানা রঙের, নানা ধরনের কাপড়ের ভারতীয় বাজারে অবাধ প্রবেশের ফলে তাঁত–শিল্পীরা আরো সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন।
১৯৯০ সালে নরসিংদী জেলায় সবচেয়ে বেশি ২০ হাজারের মতো তাঁত ছিল। গত ২৮ বছরে তা কমে টিকে আছে মাত্র এক হাজার। হোসিয়ারি শিল্পের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ১৯১৮ সালে পাবনা শহরের আশপাশে তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটে। তাঁত শিল্পের প্রয়োজনে সুতা, রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্যের বাজারও পাবনায় গড়ে ওঠে। ১৯২২ সালে নেতাজি সুভাষ বসু একবার পাবনায় আসেন। এ সময় তিনি পাবনায় সাতটি হোসিয়ারি শিল্প পরিদর্শন করেন। তিনি এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখে মুগ্ধ হন। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত দ্রব্যের মান ও চাহিদা দেখে তিনি এ শিল্পকে বস্ত্র শিল্পের ‘মা’ বলে আখ্যায়িত করেন। এ দেশের বিখ্যাত স্বনামধন্য কবি–সাহিত্যিকগণ পাবনার হোসিয়ারি শিল্পের উৎপাদিত দ্রব্য গেঞ্জি, পাবনার তাঁত শিল্পের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ব্যবহার করতেন। বর্তমানে পাবনা জেলায় প্রায় ৫০০ হোসিয়ারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বহু শ্রমিক নিয়োজিত। পাবনায় তৈরি গেঞ্জি বর্তমানে নেপাল, ভারত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ঢাকা মারফত রফতানি হয়।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য অনেকটা প্রসিদ্ধ। টাঙ্গাইল তাঁত শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো কুটির শিল্প। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এই ঐতিহ্যবাহী শাড়ি টাঙ্গাইল জেলায় তৈরি হয় এবং এ জেলার নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। তারা দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘ্রিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইল যায় এবং পরবর্তীকালে সেখানে বসবাস শুরু করে। টাঙ্গাইলের ২০০ বছরের ঐতিহ্য টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই বাংলাদেশ পাওয়ায় বাংলাদেশ আনন্দিত ও গর্বিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের ব্যাপ্তি ও প্রসার বিশ্বরঙের কর্ণধার এবং স্বনামধন্য ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহার ভূমিকা ছিল ব্যাপক।
সুপ্রাচীকাল থেকে সিরাজগঞ্জের শাড়ি এ দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে আসছে। সিরাজগঞ্জের দক্ষ কারিগরেরা বংশানুক্রমে এ শাড়ি তৈরী করছেন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের শাড়ির কথা ছাড়াও সিরাজগঞ্জের শাড়ির উল্লেখ রয়েছে। তাঁতিরা ঠিক কবে থেকে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরি করছেন সে ইতিহাস সঠিকভাবে জানা না থাকলেও এ অঞ্চলের শাড়ির একটি ঐতিহ্য চলমান রয়েছে। বসাক শ্রেণীর তাঁতপল্লীর তাঁতিরা বংশানুক্রমে হাজার বছর ধরে এ শাড়ি তৈরি করে চলেছেন। এখানকার তাঁতিরা শুধু সুতি সুতাকে উপজিব্য করে নিজের দক্ষতায় তৈরি করেন তাঁতের শাড়ি, যা বেশ আরামদায়ক, মার্জিত ও রুচিশীল। এখানকার শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কাজ। তবে বিংশ শতাব্দীর নবম দশকে এখানকার শাড়ি তৈরিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। সে সময় তৈরি কটন শাড়ির পাশাপাশি সফটসিল্ক ও হাফসিল্ক শাড়ি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী নকশায় এখন তাঁতের শাড়ি তৈরি হচ্ছে। একটি শাড়ি তৈরি করতে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়, এর সাথে তাঁতের শাড়ির পরতে পরতে সংশ্লিষ্টদের কী পরিমাণ মমতা জড়িয়ে আছে, সে কথা আজও অনেকের কাছে অজানা। তাঁতে তৈরি শাড়ি যেকোনো নারীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশে সক্ষম। সময়ের সাথে পরিবর্তিত অবস্থায় আধুনিক নারীর রুচি, পছন্দ ও বৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সাথে সংগতি রেখে তৈরি হচ্ছে কারুকার্যখচিত আধুনিক নকশাসমৃদ্ধ তাঁতের শাড়ি। তাঁতে তৈরি হচ্ছে তাঁতের সুতির শাড়ি, দেবদাস, আনারকলি, জামদানি, সুতি জামদানি, জরি পাড়, স্বর্ণচূড়, কুমকুম, সানন্দা, কটকি, সুতিপাড়, নিলাম্বরী, ময়ূরকণ্ঠী, হাজারবুটি, ইককাত, সিল্ক, মণিপুরি, সুতিসিল্ক, হাফসিল্ক, বালুচরি, শান্তিপুরি, সফটসিল্ক, আধা রেশমি, গ্রামীণ চেকসহ নানা বাহারের ও নামের শাড়ি। আগে পদ্মপাড়, মাধবীলতা, মরবী, তেরবী, কুঞ্জলতা ও লতাপাতা পাড়ের শাড়ি তৈরি করা হলেও এখন তাঁতিরা পাড়ে পরিবর্তন এনেছেন। তাঁতে নারী ও পুরুষ উভয়ই কাজ করেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় মার্কেট, সপিংমলে শোভা পাচ্ছে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্য নয়ন কাড়া এসব বাহারি তাঁতের শাড়ি ও থ্রি–পিস।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প হস্তচালিত তাঁত শিল্প। আমাদের অর্থনীতিতে এর ভূমিকা ব্যাপক। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে দেশব্যাপী পরিচালিত তাঁত শুমারি অনুযায়ী দেশে বিদ্যমান ১,১৬,১১৭টি তাঁত ইউনিটে মোট হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা ২,৯০,২৮২টি। তন্মধ্যে চালু তাঁতের সংখ্যা ১,৯১,৭২৩টি এবং বন্ধ তাঁতের সংখ্যা ৯৮,৫৫৯টি। এই শিল্প প্রায় ৪৭,৪৭৪ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদিত করে যা আমাদের চাহিদার প্রায় ২৮ ভাগ পূরণ করে থাকে। তাঁতশিল্পীরা অসামান্য অধ্যবসায় ও পরম মমতায় যুগযুগ ধরে লালিত বংশপরম্পরায় অসাধারন দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বয়ন উৎকর্ষতায় এ দেশের তাঁতশিল্পকে তুলেধরেছে এক অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এই শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। অতীতে এবং বর্তমানে তাঁত শিল্পে উৎপাদিত পোশাক রপ্তানি করা হয় বিশ্ব বাজারে। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজন প্রায় ২২৬৯.৭০ কোটি টাকা।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ লোক নিয়োজিত রয়েছে এই শিল্পে। তবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক আমাদের এই তাঁতশিল্প আজ মৃতপ্রায়। বহুকালের অসম করারোপ, তাঁতের উপর নানা বিধি–নিষেধ, মহাজনি কারবার, পুঁজি সংকটসহ নানা আগ্রাসনের কাছে তাঁতী সমাজ বড় অসহায়। এই সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতায় এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা কষ্ট সাধ্য। দিন দিন এই তাঁতশিল্পে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে, অভাব অনটনের জন্য বংশ পরম্পরা ত্যাগ করে অনেক তাঁতি পরিবার এই শিল্প থেকে সরে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। দক্ষ কারিগর স্বল্পতাও এখন এই শিল্পের অন্যতম অন্তরায়। অনেক অঞ্চলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশীয় তাঁতশিল্প। এই অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা হস্তচালিত তাঁতশিল্পের জন্য এক কঠিনপরীক্ষা। এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা, ব্যবসায়ীক পরিকল্পনা ও সরকারী–বেসরকারী সহযোগিতা। আরও প্রয়োজন দেশীয় তাঁত বস্ত্র মানোন্নয়ন, এ শিল্পে নিয়োজিতদের পেশাগত শিক্ষা ও উন্নত প্রশিক্ষণ। পরিবর্তিত ও আধুনিক রুচিবোধের সাথে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে দক্ষ কারিগর তৈরি করা দেশীয় তাঁতশিল্পের জন্য সময়ের দাবি। ‘বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড আইন–২০১৩’ এই শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।তাঁত আমাদের কৃষ্টি, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য। আর নিজস্ব ঐতিহ্যের সাথে থাকাটাও অবশ্যই গর্বের বিষয়। আমরা দেশীয় তাঁতশিল্পের পণ্য ব্যবহার করে দেশের ঐতিহ্য কে রক্ষা করবো।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং সাবেক উপাচার্য, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।