বাংলাদেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগের সাফল্যকে সমান্তরালে দেখেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, দেশের সব অর্জন এসেছে এই দলের হাত ধরেই। আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গতকাল রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় জনগণকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে এ কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, যা আমরা প্রমাণ করেছি। বাঙালির সকল অর্জনেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের মানুষের যতটুকু অর্জন তা আওয়ামী লীগের দ্বারাই হয়েছে। আওয়ামী লীগের পদক্ষেপের কারণেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, সবসময় মানুষের সুখে–দুঃখে পাশে ছিল সংগঠনটি। কিন্তু বারবার এই দলকে আঘাত করা হয়েছে, নিশ্চিহ্নের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু যতবার এই আঘাত এসেছে দলটি ততবারই জেগে উঠেছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দেড় বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালের আজকের দিনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। ছয় বছর পর দলের নাম পাল্টে করা হয় আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর পঞ্চাশের দশকে বাঙালির অধিকার আদায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠে দলটি। পরে ষাটের দশকে নানা ঘটনাপ্রবাহ শেষে ১৯৭১ সালে তাদের নেতৃত্বে হয় মুক্তিযুদ্ধ, আত্মপ্রকাশ হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এবার তিন দিনের আয়োজন রাখে আওয়ামী লীগ, যার সবশেষ ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এই জনসভা। এর প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয় ‘গৌরবময় পথ চলার ৭৫ বছরে আওয়ামী লীগ, সংগ্রাম সংকল্প সতত শপথে জনগণের সাথে। বিকালে জনসভা শুরু হলেও সকাল ১১টার দিকেই উদ্যানের ফটকগুলো খুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে মূল দল ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা উদ্যানে জড়ো হতে শুরু করেন।
বিকাল সাড়ে ৩টার পর পর সমাবেশ স্থলে এসে পৌঁছান বঙ্গবন্ধু কন্যা। মঞ্চে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তিনি। দলীয় পতাকা তোলেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পায়রাও অবমুক্ত করেন শেখ হাসিনা। পৌনে ৪টার দিকে মঞ্চে বসেন তিনি। এরপর মঞ্চের ডান পাশে নির্ধারিত স্থানে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর থিম সং এবং দেশাত্মবোধক নানা গান ও নাচ পরিবেশন করেন।
এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন ওবায়দুল কাদের। সভাপতির বক্তব্য দিতে শেখ হাসিনা মাইকের সামনে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। তিনি নিজেও স্লোগান ধরেন। সভা মঞ্চ থেকে সামনের দিকে প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মী বসার ব্যবস্থা থাকলেও পুরো উদ্যান ঘিরেই ছিল নেতাকর্মী। অনুষ্ঠানে দেশি–বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিরা অংশ নেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘সবুজ ধরিত্রী’ নামে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এগিয়ে যেতে হবে : টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার বিষয়টিও উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। আর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এটা ধরে রেখেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারুক, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকে তার সরকারের সফলতাগুলোও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩৩টি আসন পেয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ আস্থা রেখেছিল আওয়ামী লীগের ওপর। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এরপর বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা যে ঘোষণা দিয়েছিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব, তা করেছি। দারিদ্র্যের হার কমিয়েছি। আমরা দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে যে কাজ করেছি, তাতে দেশ মর্যাদা পেয়েছে।
গণমানুষের সংগঠন : দীর্ঘ বক্তব্যে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু, পাকিস্তান আমলের সংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, দল ভাঙার চক্রান্ত, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঐক্যের বিষয়টি তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকেও স্মরণ করেন জাতির পিতার মেয়ে। দলের প্রথম সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের কথা উল্লেখ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
আওয়ামী লীগই সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে জাতির সব অর্জন এনেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বারবার এই দলের প্রতি আঘাত এসেছে। বারবার এই দলকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টা হয়েছে। বারবার দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। আইয়ুব খান থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বারবার এইভাবে আঘাত এসেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ গণমানুষের সংগঠন। তাই বারবার আঘাত এসেও আওয়ামী লীগের ক্ষতি করতে পারেনি।
১৯৭৫–এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরের ইতিহাসও তুলে ধরেন জাতির পিতার কন্যা। তিনি বলেন, এরপর ক্ষমতা পরিবর্তন হয় অস্ত্রের মাধ্যমে বা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন তারা করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা সন্ত্রাসবাদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, দুর্নীতি করেছে। তারা জনগণের শক্তি ভুলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে।
নেতারা ভুল করেছেন, কর্মীরা না : বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের আর্থসামাজিক উন্নতি করার সংগঠন। বারবার আঘাত করেও এই সংগঠনের কোনো ক্ষতি করতে পারে নাই। ফিনিঙ পাখি যেমন পুড়িয়ে ফেলা ভস্ম থেকে জেগে ওঠে, আওয়ামী লীগ ঠিক সেইভাবে জেগে উঠেছে। বেশিদিনের কথা না, ২০০৭ সালেও চেষ্টা করা হয়েছিল; আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে নতুন কিংস পাটি গড়ে তুলবে, সেটাও সফল করতে পারেনি। কারণ আওয়ামী লীগের মূল শক্তি হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ, তৃণমূলের মানুষ, আওয়ামী লীগের অগণিত মুজিব আদর্শের সৈনিক। এই সৈনিকরা কখনো পরাজয় মানে না, মাথা নথ করে না।
দলছুট নেতারা ভুল করেছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের শক্তি হচ্ছে এ দেশের তৃণমূলের জনগণ এবং দলের নেতাকর্মীরা। কেউ মনে করেছেন আওয়ামী লীগে থাকলে তারাই হয়ত বড় নেতা। দলের থেকে নিজেকে বড় মনে করে কেউ দল ছেড়ে গিয়ে অন্য দল করেছেন, কেউ দল গঠন করেছেন, তারা ভুল করেছেন। ভুলে গিয়েছিলেন তারা আলোকিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন বলেই। চলে যাওয়ার পর ওই তারা আর জ্বলেন নাই। তারা আস্তে আস্তে নিভু নিভু, কেউ কেউ নিভে গেছে। কেউ ভুল বুঝে ফিরে এসেছে, আমরা নিয়েছি। কেউ এখনো আওয়ামী লীগের সরকার পতন, ধ্বংস, নানা জল্পনা কল্পনা করে যাচ্ছে।
সংগঠন শক্তিশালী করুন : দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সংগঠনকে সুসংগঠিত করতে হবে। একজন রাজনীতিবিদের জীবনে সংগঠন হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী। যদি সংগঠন শক্তিশালী হয় এবং দেশের গণমানুষের সমর্থন পাওয়া যায়, তাহলে যতই ষড়যন্ত্র হোক; হ্যাঁ, মৃত্যু যে কোনো সময়েই হতে পারে, সেজন্য আমি কখনই ভীত না, কখনো ভয় পাই না, পাব না। কারণ যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমার বাবার যে চিন্তা চেতনা, তা বাস্তবায়ন করে এ দেশের মানুষদের একটা উন্নত জীবন দেব, এটাই আমাদের লক্ষ্য। জনগণের আস্থা–বিশ্বাস, যেটা আমাদের মূল শক্তি সেটা অর্জন করতে হবে। কারণ এই আস্থা–বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি বলেই বারবার জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকারের এসে আমরা অনেক কিছু করেছিলাম। ওই সময়ে বাংলাদেশের মানুষ প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিল, একটি দলের কাজ হচ্ছে জনগণের সেবা করা।
বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ : বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ আর ভালোবাসার কথা স্মরণ করে এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তার কন্যা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। আর আমি বড় সন্তান হিসেবে পাশে থেকে জেনেছি তার স্বপ্ন; কীভাবে তিনি বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই তিনি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছিলেন; কীভাবে দেশ চলবে। সেই মোতাবেক সময় পেয়েছিলেন মাত্র তিন বছর ৭ মাস। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, শোষিত বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের হাহাকার, ওই অবস্থায় দেশকে গড়ে তুলে তিনি মাত্র তিন বছরে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। এত কম সময়ে এত উন্নতি পৃথিবীর কোনো দেশ করতে পেরেছিল কিনা আমি জানি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেটি করতে পেরেছিলেন। যুদ্ধের পর বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছান, রিলিফ পৌঁছান, পায়ে হেঁটে, নৌকায় করে এই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই করেছে, তারা গণমানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এরপর ২১ বছরের ইতিহাস পেছনে চলে যাওয়ার ইতিহাস। বঞ্চনার ইতিহাস, ক্ষুধার্ত নরনারীর হাহাকার আর দুর্ভিক্ষের ইতিহাস। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া, ১৫ আগস্টের খুনিদের বিচারে ইনডেমনিটি দিয়ে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করার কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশ শুধু পিছিয়েছে উল্লেখ করে তার কন্যা বলেন, ১৫ আগস্টের পর বারবার ক্ষমতা বদল হয়েছে। ক্ষমতা বদল হয়েছে হয় অস্ত্রের মাধ্যমে, না হয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা; কোনো ভাগ্যই তারা পরিবর্তন করতে পারেনি। নিজেদের বিলাসিতা, অর্থ সম্পদ বানানো, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, খুনখারাবি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি; এটা ছিল তাদের কাজ। ওই অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিপথে নিয়ে ওখানেই তারা ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে তারা। তারা ভুলে গেছে জনগণের শক্তি অপরিসীম শক্তি।