বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরে কর্মরত মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটিভরা আজকাল এক অমানবিক জীবন যাপন করছেন। একটি নির্দিষ্ট পেশা হয়ে দাঁড়িয়ে, তারা যেন একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক শ্রম দাস। প্রতিদিন তাদের জীবনে এক ধরনের অবিচার এবং শোষণের চিত্র দেখা যায়, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা এই কর্মীদের প্রতি শোষণমূলক আচরণ করছে এবং তাঁদের ন্যূনতম শ্রম অধিকারও মেনে চলছে না।
কর্মঘণ্টা এবং শর্তের অমানবিকতা : ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটিভদের জন্য কর্মঘণ্টা একেবারে অমানবিক। তারা প্রতিদিন সকাল ৮টায় কাজে যোগদান করে এবং রাত ১২টার পর বাড়ি ফিরে। এর মাঝে তাদের কর্মক্ষেত্রে বিরাট চাপের মধ্যে থাকতে হয়, কারণ ডাক্তারদের সাথে দেখা করার জন্য কখনো কখনো দীর্ঘ সময় ধরে তাদের চেম্বারের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, অনেক সময় রোগী দেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে অপেক্ষা করতে হয় এবং সেটা রাত ১২টা ১টাও হয়ে যায়। আবার তাদেরকে অনেক সময় ডাক্তারদের এবং তাদের এটেন্ডেন্টদের কাছ থেকে অপ্রীতিকর মন্তব্য শুনতে হয়।
ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলি তাদের কর্মীদের পেশাগত মর্যাদাকে অগ্রাহ্য করে, এমনকি অনেক ক্লিনিক এবং মেডিক্যাল সেন্টারে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ডে ‘মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের প্রবেশ নিষেধ’ লিখে রাখা হয়। সেলফ সার্ভের নামে কিছু প্রতিষ্ঠানে রিপ্রেজেনটিভদের রোগীর প্রেসক্রিপশনের ফটোগ্রাফি তোলার জন্য বাধ্য করা হয়, যা রোগীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে এবং প্রায়ই রোগী ও তাদের আত্মীয়দের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে রিপ্রেজেনটিভদেরকে নানা সময় মারধর সহ নানান হেনস্তার শিকার হতে হয়।
শ্রম আইন এবং শোষণ : এদিকে, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলি রিপ্রেজেনটিভদের প্রতি আরও একটি অবিচার করছে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তারা অনেক সময় ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে রাখে এবং চাকরির শর্তাবলীতে এমন কিছু শর্ত থাকে, যা কর্মীদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করতে বাধ্য করে। এই ধরনের চুক্তি, যেখানে কোম্পানিগুলি ৩০০ টাকার স্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে থাকে, যা এক ধরনের বাধ্য শ্রমেরই নামান্তর। এক্ষেত্রে যদি কর্মীরা তাদের চাকরি ছাড়তে চান, তাহলে কোম্পানি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়।
এটি স্পষ্টভাবে শ্রম আইনের লঙ্ঘন এবং বাধ্য শ্রমের একটি উদাহরণ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এর কনভেনশন ২৯ ও ১০৫ এবং বাংলাদেশের সংবিধান ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আমাদের দেশে সব ধরনের বাধ্য শ্রম নিষিদ্ধ। কিন্তু কোম্পানিগুলি এ সমস্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আইনকে উপেক্ষা করে তাদের কর্মীদের শোষণ করে যাচ্ছে।
ছুটি এবং সাপ্তাহিক বিরতি : আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটেটিভদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তারা সরকারি ছুটির দিনেও কাজ করতে বাধ্য হয়, এমনকি তারা নৈমিত্তিক ছুটি, পীড়া ছুটি কিংবা অর্জিত ছুটির সুবিধাও ভোগ করতে পারে না। শুধুমাত্র ঈদ–উল–ফিতর এবং ঈদ–উল–আজহার সময় ৩ দিন করে মোট ৬ দিন ছুটি পাওয়া যায়। এই অবস্থা কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সংগঠন এবং প্রতিবাদ : ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটেটিভদের মধ্যে এখন সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা উপলব্ধি করছে যে, তারা শোষিত হচ্ছে এবং তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, তারা ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটেটিভ এসোসিয়েশন (ফারিয়া) নামে একটি সংগঠন গঠন করেছে। গত ৮ নভেম্বর, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে প্রায় পাঁচ হাজার রিপ্রেজেনটেটিভ একত্রিত হয়ে মানববন্ধন ও র্যালি করেছে, যা চট্টগ্রামের শ্রমজীবীদের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এছাড়া, ফারিয়া সংগঠন এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তবে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলি তাদের এই সংগ্রামকে অবমূল্যায়ন করতে নানা ধরনের হুমকি ও চাপ সৃষ্টি করছে। তারা দাবি করছে যে, ফারিয়ার সদস্যদের কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই এবং তাদেরকে শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয় না।
সরকারের ভূমিকা এবং সমাধান : এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ফারিয়া সংগঠনকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে এবং ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটেটিভদেরকে শ্রম আইনের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া, শ্রম আইনের ধারা ১৮৩ সংশোধন করে প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের অধীনে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন দেওয়া জরুরি। এই পদক্ষেপটি কর্মীদের অধিকার সুরক্ষিত করতে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু সম্পর্ক স্থাপন করতে সহায়তা করবে।
ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরের টেকসই উন্নতির জন্য মালিকপক্ষ, রাষ্ট্র এবং কর্মীদের মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে বিরোধ এবং সংঘাত কমিয়ে শিল্পের অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
উপসংহার : ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেনটেটিভদের শোষণ ও বঞ্চনার অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। শ্রম আইনের সঠিক প্রয়োগ, সংগঠিত কর্মী অধিকার এবং মালিকপক্ষের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে এই পেশার উন্নতি ও টেকসইতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। সরকারের সহায়তায় এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব, যা ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরের জন্য সুদিন বয়ে আনবে।
লেখক: সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি।