বাংলাদেশের ই২ই মার্কেটিংয়ে ক্রিয়েটিভিটির শক্তি

এম. এ. মুকিত চৌধুরী | সোমবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

বিগত কয়েক বছরে, বাংলাদেশে ব্যবসা থেকে ব্যবসায় (B2B) মার্কেটিংয়ে সৃজনশীলতার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও সৃজনশীল কৌশল গ্রহণ করে তাদের ব্র্যান্ডকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রচারণা নয়, বরং ব্যবসায়িক সংস্কৃতি, গ্রাহক সম্পৃক্ততা, এবং সম্পর্ক উন্নয়নেও সৃজনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কর্পোরেট ইভেন্ট, ব্র্যান্ডেড কন্টেন্ট, এবং ইমারসিভ মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত তাদের প্রভাব বাড়িয়ে তুলছে।

বাংলাদেশে B2B মার্কেটিংয়ে সৃজনশীলতার ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান, এবং এর সাথে সাথে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে সৃজনশীল মার্কেটিং কৌশল গ্রহণ করতে হচ্ছে। সৃজনশীলতা শুধুমাত্র পণ্য বা সেবার প্রচারণায় নয়, বরং ব্র্যান্ডের পরিচিতি, গ্রাহকদের আস্থা অর্জন, এবং দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে, ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং, ইন্টারেক্টিভ কনটেন্ট, অভিজ্ঞতামূলক ইভেন্ট, এবং ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (VR/AR) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্র্যান্ডগুলো আরও বেশি কার্যকরভাবে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছে।

সৃজনশীল কৌশলসমূহ

. কন্টেন্ট মার্কেটিং বাংলাদেশে কন্টেন্ট মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের লক্ষ্যবস্তু গ্রাহকদের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করছে। ব্লগ, ভিডিও, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, এবং পডকাস্টের মাধ্যমে তারা তথ্যবহুল ও মানসম্পন্ন কন্টেন্ট প্রদান করছে, যা তাদের ব্র্যান্ডকে আরও প্রাসঙ্গিক ও আকর্ষণীয় করে তুলছে। এছাড়া, লাইভ ওয়েবিনার এবং ইন্টারেক্টিভ ইনফোগ্রাফিকের মতো মাধ্যমও ব্যবহার করা হচ্ছে, যা দর্শকদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্লগ পোস্ট, ভিডিও টিউটোরিয়াল এবং ওয়েবিনারএর মাধ্যমে তাদের সেবা ও পণ্য সম্পর্কিত শিক্ষামূলক কনটেন্ট প্রকাশ করছে। এটি শুধু সম্ভাব্য গ্রাহকদের আকর্ষণই করছে না, বরং প্রতিষ্ঠানের নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী গ্রাহক সম্পর্ক গঠনে সহায়তা করছে।

. লিঙ্কডইন ব্যবহার লিঙ্কডইন এখন বাংলাদেশে ই২ই মার্কেটিংয়ের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। প্রতিষ্ঠানগুলো লিঙ্কডইনে তাদের ব্র্যান্ডের উপস্থিতি বাড়িয়ে, কন্টেন্ট শেয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইট প্রদান, টার্গেটেড বিজ্ঞাপন, এবং প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে সঠিক লক্ষ্যবস্তু গ্রাহকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সাফল্য অর্জন করছে।

একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশি সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর লিঙ্কডইন স্ট্র্যাটেজি, যেখানে তারা গ্রাহকদের জন্য কেস স্টাডি, ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইট, এবং ওয়েবিনার আয়োজনের পাশাপাশি ইন্টারঅ্যাক্টিভ পোস্ট, লিডারশিপ থট কন্টেন্ট এবং গ্রাহকদের সফলতার গল্প প্রকাশ করে মার্কেটিং চালিয়ে যাচ্ছে।

. ব্র্যান্ডিং ও ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি সৃজনশীল ব্র্যান্ডিং এবং ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি বাড়াতে সহায়তা করে। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করে তাদের ব্র্যান্ডকে আলাদা করে তুলছে। অনেক ব্র্যান্ড তাদের লোগো, প্যাকেজিং ডিজাইন এবং বিজ্ঞাপনে ঐতিহ্যবাহী রঙ, মোটিফ এবং বাংলা টাইপোগ্রাফি ব্যবহার করছে, যা গ্রাহকদের আবেগের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ব্র্যান্ডের প্রতি তাদের আস্থাকে আরও দৃঢ় করে তোলে।

কিছু কোম্পানি তাদের ব্র্যান্ডিংয়ে বাংলা টাইপোগ্রাফি এবং দেশীয় শিল্পকলাকে অন্তর্ভুক্ত করছে, যা তাদের দেশীয় গ্রাহকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলছে।

কর্পোরেট ইভেন্ট ও সংস্কৃতির সংযোগ

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র পণ্য বা পরিষেবার প্রচারণায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তারা কর্পোরেট সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজন করছে, যা B2B মার্কেটিংয়ে নতুন মাত্রা যোগ করছে।

. পহেলা বৈশাখ উদযাপন বৈশাখী মেলা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান এবং স্থানীয় খাবারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মী ও ক্লায়েন্টদের সাথে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলছে। B2B ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্য ও সেবাকে বৈশাখী থিমে উপস্থাপন করে নতুন ও সৃজনশীল উপায়ে বাজার ধরার চেষ্টা করছে।

উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ অফার চালু করে এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রচারণা চালিয়ে গ্রাহকদের সংযুক্ত রাখে।

. পিঠা উৎসব বাংলাদেশের শীতকালীন ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসব কর্পোরেট পরিবেশেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের কর্মীদের নিয়ে পিঠা প্রতিযোগিতা ও উৎসবের আয়োজন করে, যা ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি কর্মীদের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় করে।

অনেক কর্পোরেট সংস্থা তাদের অফিসে বা আউটডোরে পিঠা উৎসবের আয়োজন করে, যেখানে কর্মীদের পাশাপাশি ক্লায়েন্ট এবং বিজনেস পার্টনারদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটি একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সম্পর্ক গঠনের জন্য সহায়ক।

. কর্পোরেট আউটিং ও রিট্রিট বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এখন কর্মীদের মনোবল বাড়াতে, দলগত কাজের দক্ষতা উন্নত করতে এবং স্ট্রেস কমানোর জন্য কর্পোরেট আউটিং বা রিট্রিট আয়োজন করছে। কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেট, সুন্দরবনসহ বিভিন্ন মনোরম স্থানে এসব আয়োজন কর্মীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করছে, যা পরোক্ষভাবে ব্যবসায়িক পারফরম্যান্স বৃদ্ধি করে। কিছু প্রতিষ্ঠান এই আউটিংয়ে টিম বিল্ডিং কার্যক্রম, ওয়ার্কশপ, এবং রিফ্রেশমেন্ট প্রোগ্রাম যুক্ত করে এটিকে আরও কার্যকর করে তুলছে।

অনেক আইটি ও কনসাল্টিং ফার্ম বছরে একবার বড় ধরনের আউটিং আয়োজন করে, যেখানে কর্মীদের সঙ্গে ক্লায়েন্ট এবং পার্টনারদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা নেটওয়ার্কিং এবং বিজনেস ডেভেলপমেন্টের জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

. কর্পোরেট স্পোর্টস ইভেন্ট অনেক প্রতিষ্ঠান ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের মতো কর্পোরেট স্পোর্টস ইভেন্ট আয়োজন করে। এটি কর্মীদের মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি কোম্পানির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে। এছাড়াও, এসব ইভেন্ট কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং দলগত দক্ষতা উন্নত করে। পাশাপাশি, ক্লায়েন্ট এবং বিজনেস পার্টনারদের অংশগ্রহণ করিয়ে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা যায়, যা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসায়িক সম্পর্ক গঠনে সহায়ক হয়।

সৃজনশীলতার সুফল

সৃজনশীল মার্কেটিং কৌশল গ্রহণের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিম্নলিখিত সুফল পাচ্ছে:

ব্র্যান্ড সচেতনতা বৃদ্ধি: সৃজনশীল প্রচারণা ব্র্যান্ডের পরিচিতি বাড়ায় এবং লক্ষ্যবস্তু গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে।

গ্রাহক সম্পর্ক উন্নয়ন: মানসম্পন্ন ও প্রাসঙ্গিক কন্টেন্টের মাধ্যমে গ্রাহকদের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা: সৃজনশীলতা প্রতিষ্ঠানকে প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করে এবং বাজারে বিশেষ স্থান দখল করতে সহায়তা করে।

কর্মী সন্তুষ্টি বৃদ্ধি: সৃজনশীল কর্মপরিবেশ এবং কর্পোরেট সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদীভাবে সফল হতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে B2B মার্কেটিংয়ে সৃজনশীলতা এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং একটি কৌশলগত অপরিহার্যতা। প্রতিষ্ঠানগুলো ইমারসিভ মার্কেটিং, কন্টেন্ট পার্সোনালাইজেশন এবং ডাটাড্রিভেন ইনসাইট ব্যবহার করে তাদের ব্র্যান্ডকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। উদ্ভাবনী প্রচারণা, কর্পোরেট ইভেন্ট, এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই সৃজনশীলতা শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যই নয়, বরং ব্র্যান্ডের দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্বও নিশ্চিত করছে।

লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, স্ট্র্যাটেজিক সেলস,

এলিট পেইন্ট এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রীজ লিঃ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে চা শ্রমিকদের বঞ্চনা : প্রাসঙ্গিক কথা
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে আলম-জাহানারা ফাউন্ডেশনের ইফতার সামগ্রী বিতরণ