স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবার কোম্পানি স্টারলিংক বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের গ্রাহকরা মঙ্গলবার (গতকাল) থেকেই স্টারলিংক ইন্টারনেট সংযোগের অর্ডার করতে পারবেন। এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে স্টারলিংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
স্টারলিংক শুরুতে দুটি প্যাকেজ দিয়ে বাংলাদেশে সেবা শুরু করছে– স্টারলিংক রেসিডেন্স এবং রেসিডেন্স লাইট। মাসিক খরচ একটিতে ৬০০০ টাকা, অন্যটিতে ৪২০০ টাকা। তবে সেটআপ যন্ত্রপাতির জন্য ৪৭ হাজার টাকা এককালীন খরচ হবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক এই ইন্টারনেট সেবায় কোনো স্পিড বা ডেটা লিমিট নেই। ব্যবহারকারী ৩০০ এমবিপিএস পর্যন্ত গতির আনলিমিটেড ডেটা ব্যবহার করতে পারবেন। খবর বিডিনিউজের।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের মধ্যে ফোনালাপ হয়। সেই আলোচনার সূত্রে বাংলাদেশে স্টারলিংকের সেবা চালুর উদ্যোগ শুরু হয়। এরপর ৯ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার ডাক টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, বাংলাদেশে ‘গ্রাউন্ড আর্থ স্টেশন’ স্থাপনের ব্যাপারে স্টারলিংকের হয়ে কয়েকটি স্থানীয় কোম্পানি কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে ভূমি বরাদ্দ, নির্মাণ সহায়তা ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের মত কার্যক্রম পরিচালনায় স্টারলিংকের সঙ্গে কয়েকটি সহযোগিতা চুক্তি করে সরকার।
বিনিয়োগ সম্মেলনের তৃতীয় দিন ৯ এপ্রিল সম্মেলনের ভেন্যু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পরীক্ষামূলকভাবে স্টারলিংকের সেবা চালিয়ে দেখানো হয়। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর জন্য ২৮ এপ্রিল স্টারলিংকের লাইসেন্সে অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা। বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ১০ বছর মেয়াদী দুটি লাইসেন্স পেয়েছে স্টারলিংক। এর একটি হচ্ছে ‘ননজিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট অপারেটর লাইসেন্স’; অন্যটি ‘রেডিও কমিউনিকেশন অ্যাপারেটার্স লাইসেন্স’। লাইসেন্স পাওয়ার এক মাসের মধ্যে তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করল।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, সোমবার বিকালেই স্টারলিংক তাকে ফোন করে বাংলাদেশে অফিসিয়ালি যাত্রা শুরুর কথা জানায়। আর গতকাল মঙ্গলবার সকালে স্টারলিংকের এঙ হ্যান্ডেলেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা গত ২৯ মার্চ বাংলাদেশে ৯০ দিনের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তার বিশেষ সহকারী তৈয়্যব লিখেছেন, ৯০ দিনের মধ্যে যাত্রা শুরুতে স্যারের প্রত্যাশাটি বাস্তবায়িত হল।
যেভাবে মিলবে স্টারলিংকের ইন্টারনেট, যা যা সুবিধা থাকবে : স্টারলিংক বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা শুরুর পর সেবাটি নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টায় রয়েছে মানুষ। কারা, কীভাবে, কত টাকা খরচ করে নেওয়া যাবে এই সেবা, কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে– এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। বাংলাদেশে স্টারলিংকের বাণিজ্যিক যাত্রার বিস্তারিত জানাতে গতকাল দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তৈয়্যব; সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ–প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।
তৈয়্যব বলেন, স্টারলিংকের একটি ৪৭ হাজার টাকা দামের সেটআপ একটি মোবাইল টাওয়ারের সমান ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারবে। যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট দেওয়া সহজ হবে। আর ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা বা ইন্টারনেটনির্ভর কাজ করেন এমন ব্যক্তি ও সংস্থা নিরবচ্ছিন্ন উচ্চগতির ইন্টারনেট পাবেন। বাংলাদেশে এখনো স্টারলিংকের গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, স্টারলিংকের ওয়েবসাইট থেকেই সেবার গ্রহণের অর্ডার করা যাবে। যন্ত্রপাতির মধ্যে থাকবে একটি স্যাটেলাইট ডিশ অ্যান্টেনা, ওয়াইফাই রাউটার, মাউন্টিং ট্রাইপড ও প্রয়োজনীয় কেবল। এই যন্ত্রপাতিগুলো সহজে স্থাপনযোগ্য এবং স্থাপন করা শেষ হলেই গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করতে পারবেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই স্টারলিংক নিয়ে মানুষের সাধারণ কিছু প্রশ্নের লিখিত উত্তর পড়ে শোনান ফয়েজ আহমদ। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, স্টারলিংক ইন্টারনেটে কোনো ডেটা লিমিট নেই।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এখনো অপটিক্যাল ফাইবার পৌঁছায়নি। মাত্র ৩০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ারে ফাইবার আছে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর যে সেবা সেটা মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে হয়, যেটা লো ক্যাপাসিটির। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও হাজার হাজার মোবাইল টাওয়ার আছে যারা শুধু ৩০০ এমবিপিএসের ব্যান্ডউইডথ দিয়ে একটা মোবাইল টাওয়ার সচল রাখে ইন্টারনেটের জন্য এবং সেই ডেটা ইন্টারনেটটা কয়েক হাজার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয়।
স্টারলিঙ্কের ক্ষেত্রে মাত্র একটা সেটআপ বঙ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে জানিয়ে এর ব্যাখ্যায় তৈয়্যব বলেন, অর্থাৎ গ্রামের একজন উদ্যোক্তা উনি স্টারলিংকের একটা সেটআপ বঙ যেটা ৪৭ হাজার টাকা দিয়ে কিনবেন, উনি নিজে নিরবচ্ছিন্ন, লো লেটেন্সি এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। লো লেটেন্সি অর্থাৎ ডাউনলোড করতে কম সময় খরচ হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, সংসদ ভবনে কিংবা মাননীয় উপদেষ্টার বাসভবন বা তার অফিসে যে স্পিডের ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়, ঠিক একই স্পিডে দেশের প্রত্যন্ত ও দূরবর্তী অঞ্চল যেমন পার্বত্য অঞ্চল, হাওরাঞ্চল কিংবা বনাঞ্চলে যেকোনো গ্রাহক উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। এটি ডিজিটাল বৈষম্য রোধে একটা কার্যকর পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।
স্টারলিংক কি উদ্যোক্তা বান্ধব? উদ্যোক্তারা কীভাবে স্টারলিংক সেবা দেবেন? এই প্রশ্নে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, আমরা এনজিএসও’র বিধিবিধান এমনভাবে করেছি যেন স্টারলিংক বা সমজাতীয় ইন্টারনেট সুবিধা উদ্যোক্তা বান্ধব হয়। অর্থাৎ, একজন উদ্যোক্তা কিংবা একাধিক উদ্যোক্তা নিজেরা যদি ৪৭ হাজার টাকার একটা তহবিল গঠন করে এই তহবিলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেটআপ বঙ কিনবে। এর মাধ্যমে তারা তাদের আশপাশের দোকানে এই ইন্টারনেট বিক্রি বা সেবা দিতে পারবে। ওয়াইফাই রেঞ্জ আনুমানিক ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ মিটার, এই ৫০ মিটার জোনের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রামের গ্রোথসেন্টারগুলোতে অনেক দোকানপাট থাকে। সেখানে সহজেই ইন্টারনেট সেবা এক ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তি সমিতি আকারে কিনে সেটার মাল্টিপল ব্যবহার সম্ভব। আইনে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়নি। এছাড়া শহরের বাসভবনে ওয়াইফাই শেয়ারিং করে ইন্টারন্টে ব্যবহার সম্ভব। স্টারলিঙ্কে যেহেতু বিল্টইন রাউটার আছে সেহেতু রাউটার হতে রাউটারে আইএসপি সেটাপেও ব্যবহার সম্ভব।
ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করে, সে চেষ্টাও করা হবে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি যারা নাগরিক সেবার উদ্যোক্তা হবেন, তাদের জন্য স্টারলিংক কীভাবে সহজে নেওয়া যায়–সেজন্য অর্থায়ন প্যাকেজ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলেও জানান তৈয়্যব। তিনি বলেন, স্টারলিংকের দাম কিছুটা বেশি। মাসিক খরচ ছয় হাজার এবং চার হাজার দুইশ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এটা আমরা স্টারলিংকে কিছুটা নেগোসিয়েশন করে কমিয়েছি। কিন্তু যেহেতু এটা শেয়ার করা যাবে, শেয়ার করার ওপর যেহেতু আমরা বিধিনিষেধ রাখিনি এবং বিক্রি করার উপরও বিধিনিষেধ রাখিনি, সেজন্য এই ইন্টারনেট দিয় সফল ব্যবসা মডেল, এসএমই বা ব্যবসা মডেল তৈরি করা সম্ভব।
বিশেষ সহকারী বলেন, পাশাপাশি কেউ যদি এই স্টারলিংক ব্যবহার করে (মোবিলিটি এবং রোমিং সুবিধা ছাড়া) সেটাকে ফিড করে ব্যবহার করে সেখানেও আমরা কোনো বাধা রাখিনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের এসএমই কিংবা উদ্যোক্তা বিকাশে সব ধরনের ফ্যাসিলিটি আইন, আইনগত ফ্যাসিলিটেশন রাখা হয়েছে। এর বাইরে আমরা সবাই প্রফেসর ডক্টর মুহম্মদ ইউনূসের ফোন লেডি কনসেপ্টে বড় হয়েছি। স্টারলিংকের মাধ্যমে আমাদের মাইক্রোক্রেডিট কিংবা ইএমআই অথবা যেকোনো এমএফআই/এমআরএ পদ্ধতিতে ফাইন্যান্সিয়াল অর্গানাইজেশনগুলো চাইলে ওয়াইফাই লেডি হিসেবে নতুন একটা উদ্যোক্তার ধারা সৃষ্টি করতে পারে। তারা চাইলে শুধু গ্রামীণ মহিলাদেরকে একটা বিশেষ ঋণ দিতে পারে, যে ঋণের মাধ্যমে তারা স্টারলিংক নিয়ে ইন্টারনেট সেবা বিক্রি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভবন ছাড়াও ইনফরমাল কো–ওয়েবিং বিজনেসের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, স্টারলিংকের একটি লোকাল গেটওয়ে থাকবে। এখন এর কমার্শিয়াল টেস্ট রান ও গ্রাউন্ড টেস্ট চলমান। এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য স্টারলিংক কোম্পানিকে ৯০ দিনের সময় দেওয়া হয়েছে, যার দশ দিন গত হয়েছে। ৯০ দিন অতিবাহিত হলেই তাদের লোকাল গেইটওয়ে বাধ্যতামূলক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এর ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি ডিভাইসের ক্ষেত্রে রেট, ভ্যাট, ট্যাঙ আছে, তাই ডিভাইসের বিষয়ে এনওসি নিবে।
সরকারি কোম্পানির স্বার্থ কীভাবে রাখা হচ্ছে– সবশেষ এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুইভাবে সরকারি কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রথমত, সরকারি সাবমেরিন কেবল কোম্পানির মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত স্যাটেলাইট কোম্পানির মাধ্যমে।