বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন এবং ব্যবহার

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য | মঙ্গলবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় কখন যে আপ্যায়ন হিসেবে চা এর ব্যবহার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে বাঙালি আদি সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক আপ্যায়নে চায়ের ব্যবহার ছিল না। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এ উপমহাদেশকে ইংরেজরা শাসন করেছে প্রায় দুইশত বছর। এ বিশাল সময়কালে তাদের সুবিধার্থে তারা এ দেশের সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় ও সামাজিক আপ্যায়নের পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট ছিল। এ উপমহাদেশে দুধ-চিনি মিশিয়ে সুস্বাদু চায়ের প্রচলন শুরু হয় ইংরেজ বণিকদের হাত ধরে। কথিত আছে, প্রথমে ইংরেজরা বিনা মূল্যে এ অঞ্চলের মানুষদেরকে চা খাওয়ানো শুরু করে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলের মানুষ যখন অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তাঁরা অর্থের বিনিময়ে চা পান করতে থাকে। আজ প্রায় ১০০ বছর পরও এ অঞ্চলের মানুষের কাছে চা খুবই জনপ্রিয়।
চা প্রচলনের শুরুতে ভেষজ পানীয় হিসেবেই এ অঞ্চলের মানুষেরা ব্যবহার করতো। ধীরে ধীরে চায়ে চিনি, লেবু ও মসলা মিশিয়ে মানুষ পান করা শুরু করে। ব্রিটিশেরা এ উপমহাদেশে ভেষজ পানীয় হিসেবে চাকে জনপ্রিয় করতে পারেনি। পরে সুস্বাদু করতে দুধ-চিনি মিশিয়ে চায়ের ব্যবহার শুরু করে। ‘চা শিল্প ও সাহিত্য’- নামক বই-এ (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত) দেখা যায়, ব্রিটিশরা চা-পানের সময় প্রথমে দুধ ও চিনির ব্যবহার শুরু করে। সে সময় তাদের উপনেবিশিক দেশ জ্যামাইকা থেকে চিনি আমদানি করে চায়ে ব্যবহার করে ইংরেজরা। আজ প্রায় ১০০ বছর পরও এ দেশের মানুষের কাছে দুধ-চা সমান জনপ্রিয়। ক্ষেত্র বিশেষে তা আরো বেড়েছে। বর্তমানে সুপারশপ, পাড়ার দোকান, অজপাড়া গাঁয়ে টংগী দোকান কিংবা দুর্গম এলাকায় বেড়ার ছাউনির ছোট্ট দোকানেও পাওয়া যায় চা বা চায়ের প্যাকেট। কয়েক বছর ধরে গ্রিন টি, মসলা টিসহ নানা স্বাদের চায়ের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশে খুচরা বিক্রেতার হাত ধরে প্রতিদিন গড়ে আড়াই লাখ কেজির মতো চা বাজারে বিক্রয় হয়। চায়ের এ বিশাল বাজার বড় হচ্ছে চা কোম্পানিগুলোর হাত ধরে। বছরে যত চা পান করা হয়, তার সিংহভাগই দুধ-চিনি মিশিয়ে পান করেন এ দেশের মানুষ। স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে চা থেকে অনেকেই চিনি বাদ দিলেও চায়ে দুধের ব্যবহার কমেনি। তবে অফিসে লিকার চা চলে বেশি। দুধ-চা তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় কড়া লিকার। আর কড়া লিকার হয় সিটিসি (ক্রাশ, টিয়ার অ্যান্ড কার্ল) পদ্ধতিতে উৎপাদিত চা। উঁচু-নীচু সারি সারি পাহাড়ের কোলে থাকে চা-এর সবুজ গাছগুলো। বিশেষ করে ভরা মৌসুমে যখন সুবজ পাতা গজায় তখন পুরো পাহাড় সবুজ বলে মনে হয়। শ্রমিকদের নিবিড় পরিচর্যায় এবং মৌসুমের অনুকূল আবহাওয়ায় চা-গাছে সবুজ পাতা গজায়। কোমর সমান উঁচু চা গাছ থেকে দুইটি পাতা একটি কুঁড়ি তুলে শ্রমিকেরা। পাতাগুলো তুলে বস্তায় ঢোকানো হয়। অথবা ট্রলির সুবিধা থাকলে পাতাগুলো ট্রলি করে এনে কারখানার সামনে রাখা হয়। বস্তা খুলে পাতাগুলো চলায়মান বেল্টের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। অথবা ট্রলি করে আনা পাতাগুলো বেল্টের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। চলন্ত বেল্টে চড়ে সবুজ পাতার স্তুপ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এসব সবুজ পাতায় থাকে সাড়ে ৭৬ শতাংশ পানি। প্রথম ধাপে হালকা বাতাসে আর দ্বিতীয় ধাপে দূর থেকে গ্যাস বার্নারের তাপে পাতা থেকে পানি শোষণ করার পালা শুরু হয়। কারখানার ভাষায় এটাকে ‘উইদারিং’ বলে। যন্ত্রভেদে এতে সময় লাগে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা। এভাবে প্রায় ২০ শতাংশ পানি ছড়িয়ে নেয়া হয়। পানি ছড়ানোর পর বেল্টে থাকা পাতাগুলো তখনও সবুজাভ থাকে। এবার এ সবুজাভ পাতাগুলো আর এক বেল্টের মাধ্যমে চলে যায় দ্বিতীয় শেডে। দ্বিতীয় শেডে থাকে একটি ‘রোটার ভ্যান’ যন্ত্র। সবুজাভ পাতাগুলো ঐ ‘রোটার ভ্যান’ যন্ত্রে গিয়ে পড়ে। এ যন্ত্রে পাতাগুলো ছোট ছোট করে কাটা হয়। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় ঘূর্ণায়মান লোহার দাঁতযুক্ত একটি যন্ত্রে। এ যন্ত্রটির নাম হয় ‘সিটিসি’ বা ‘ক্রাশ, টিয়ার অ্যান্ড কার্ল যন্ত্র। সবুজাভ পাতাগুলোকে এখানে চার দফায় চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়। এ চূর্ণবিচূর্ণ পাতার অংশ এখনও সবুজ থাকে। এ পাতার টুকরোগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় ঘুরতে থাকা গোলাকার পাইপের মতো ‘গুগি’ নামক যন্ত্রে। এখানেই পাতার টুকরোগুলো ছোট ছোট বলের আকার ধারণ করে, গুগি থেকে পাতার টুকরোগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বড় ট্রেতে চলে যায়। বড় ট্রেতে আসার পর শুরু হয় অক্সিডেশন। এ ধাপের প্রধান কাজ হলো চায়ের রূপ পরিবর্তন করা। কারখানার ভাষায় এ ধাপকে বলা হয় ফার্মেন্টেশন। এ পর্যায়ে বাতাসের সাহায্যে দুই ঘন্টা ধরে অঙিডেশন করার পর পাতার সবুজাভ দানাগুলো তামাটে রং ধারণ করে। এর পরের ধাপে বার্নারের সাহায্যে চা-দানা থেকে জলীয় অংশ শুকিয়ে নেয়া হয়। এরপরই বের হয়ে আসে কালো রং এর চায়ের দানা। এখানেই চা-এর উৎপাদন প্রক্রিয় শেষ নয়। কালো রং এর চা-এর দানাগুলো চলতে থাকা বেল্ট নিয়ে যায় একটি স্বয়ংক্রিয় চালনিতে। চালনির সাহায্যে উৎপাদিত চা-কে তিনভাগে ভাগ করা হয়। একভাগে মিহিদানা চা, আর একভাগে মাঝারি দানাদার চা এবং অন্য ভাগে মোটা দানাদার চা। চালনির নীচে বস্তা থাকার কারণে সমগ্র চা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। চূড়ান্তভাবে এসব চাকে আবার চালনিতে পরিষ্কার করে নেয়া হয়। শুরুতে যে সবুজ পাতার ৭৬ দশমিক ৫০ শতাংশ পানি ছিল, এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আড়াই থেকে ৩ শতাংশ পানি থাকে। বাস্তবতায় হাতে স্পর্শ ছাড়াই চা তৈরি হয়। অবশ্য বাগান ভেদে উৎপাদন পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু হয় না এমন মানুষ বাংলাদেশে কম আছে। ফুটপাতের টংদোকান থেকে শুরু করে পাঁচতারকা হোটেল, কুঁড়েঘর থেকে বঙ্গভবন- সবখানেই চায়ের সমান কদর। মানুষ শুধুমাত্র সকালেই চা পান করে না বরং ক্লান্ত দুপুর, অলস বিকাল কিংবা সন্ধ্যার আড্ডা জমিয়ে তোলে এক কাপ চা। বাংলাদেশের মানুষ একদিনে কত কাপ চা পান করে তা বাংলাদেশ চা বোর্ডের এক হিসাব থেকে পাওয়া যায়। তাঁদের তথ্য অনুসারে প্রতিদিন বাংলাদেশের মানুষ ১০ কোটি ৪৩ লাখ চা পান করে। আর প্রতি কাপ চায়ের জন্য বাগান থেকে তুলতে হয় ১১ গ্রাম সবুজ পাতা-কুঁড়ি। চা বোর্ড-এর তথ্য অনুসারে ২০০১ সালে বাংলাদেশে একজন মানুষ গড়ে চা পান করেছে ১১৩ কাপ। আর ২০১৯ সালে পান করেছে ২২৯ কাপ। অর্থাৎ চা পান করার গতি ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে প্রতিবছর গড়ে চা-এর চাহিদা বাড়ছে ৫.২৫ শতাংশ হারে। বিশ্বে চা পানে শীর্ষে রয়েছে তুরস্ক। ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটির তথ্য অনুসারে তুরস্কের একজন মানুষ বছরে ৩ কেজির বেশি চা ভোগ করেন। এ তিন কেজি দিয়ে ১ হাজার ২০০ কাপ চা তৈরি করা যায়। এর পরের অবস্থান লিবিয়া, মরক্কো, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও হংকংয়ের। জনসংখ্যার কারণে দেশভিত্তিক মোট চা পানের শীর্ষস্থানটা চীনের দখলে। চীনের জনগণ বছরে ২০০ কোটি কেজির বেশি চা ভোগ করে। ভারতের মানুষ ভোগ করে ১০৩ কোটি কেজি। মোট চা পানে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ১২তম। তিন দশক আগে ছিল ১৫তম। বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়লেও করোনার কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। অবশ্য সমগ্র বিশ্বে একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়। এ সময়ে উৎপাদন ছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন কমেছে ১ কোটি কেজি। অবশ্য ভারতে উৎপাদন কমেছে ১৫ কোটি কেজি। শ্রীলংকায় কমেছে ৩ কোটি কেজি। একইভাবে করোনাকালীন সময়ে উৎপাদন কমেছে উগান্ডা, তানজানিয়া প্রভৃতি দেশেও।
চা-গাছের কুঁড়ি দ্রুত ছড়ানোর জন্য পরিমাণ মতো বৃষ্টি ও স্বাভাবিক রোদ থাকা দরকার। ২০২০ সালের শুরুতে খরা এবং শেষে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো না পাওয়ায় সবুজ পাতার উৎপাদন কমেছে। এ কারণে বছরের একমাস বাকি থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের তুলনায় ১ কোটি কেজি উৎপাদন কমেছে। বাংলাদেশে মোট চা বাগানের সংখ্যা হয় ১৬৭টি। চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৬৭টি বাগানে চা উৎপাদন হয়েছে ৭ কোটি ৯৪ লাখ কেজি। ২০১৯ সালে একই সময়ে চা উৎপাদন হয়েছিল ৮ কোটি ৯৬ লাখ কেজি। এ হিসেবে গত বছরের তুলনায় উৎপাদন কমেছে ১ কোটি ২ লাখ কেজি। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ দেশের মানুষদের চা এর চাহিদা পূরণে দেশের ১৬৭টি বাগানে ক্রমাগত চা উৎপাদন করে যাচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতিও হয়ে উঠেছে সতেজ।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে আওয়ামী লীগের মতবিনিময় সভা