বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমান সময়ে পণ্যের দাম বা মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে বড় বিপদে। কারণ তাদের আয়ের সাথে ব্যয়ের কোন সামঞ্জস্য নেই। আমাদের মত দরিদ্র দেশে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এদেশের সমাজ ব্যবস্থাকে আঘাত করেছে। সমাজের শ্রেণি বিন্যাসে অতি দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত এ চারটি শ্রেণি রয়েছে। সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে শতকরা বিশভাগ লোক দরিদ্র। এ তথ্যকে যদি গ্রহণ করি তবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমাজের শ্রেণি বিন্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। অর্থাৎ অতি দরিদ্র শ্রেণি নেমে গেছে আরো নিচে। আর নিম্ন–মধ্যবিত্ত নেমে গেছে অতি দরিদ্র শ্রেণিতে। অনুরূপভাবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। অতএব বলা যায় পণ্যের মূল্য বা দাম বৃদ্ধি সমাজ কাঠামোকেও পরিবর্তন করে।
বাংলাদেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কি পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে? পণ্য ও সেবায় মূল্য বাংলাদেশে কেমন আর অন্যান্য দেশে কেমন– তা বিশ্লেষণ করার জন্য রেনডম স্যাম্পল হিসেবে কিছু পণ্য নিয়ে দুই বা তিন দেশের পণ্যমূল্যের সাথে তুলনা করা যায়। অতি সম্প্রতি আমার দুইটি দেশে ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। যেহেতু আমি একজন অর্থনীতির শিক্ষক সেহেতু ঐ দুই দেশের কিছু পণ্য মূল্যের ওপর জরিপ চালানো সম্ভব হয়েছে। সিঙ্গাপুর একটি পরিচ্ছন্ন ও ছোট শহর। এ শহরটিকে সিটি টাউনও বলা হয়। এ শহরে সবচেয়ে বিখ্যাত মার্কেটটি হয় মোস্তফা মার্কেট। মোস্তফা মার্কেটের তিনটি বিল্ডিং আছে। এ তিনটি বিল্ডিং এর মধ্যে সম্ভবত সবটি মাটির নীচে দুই তলা এবং মাটির ওপরে চার তলা। এমন কোন জিনিস নেই এই মার্কেটে পাওয়া যায় না। ক্রেতারও অভাব নেই। এ তিনটি বিল্ডিং হয় এক একটি শপিং মল। সুতরাং হাজার হাজার ক্রেতা এই মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করছে। ক্রেতাদের মধ্যে ইন্ডিয়ান বেশি। খাদ্য পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় মাঝারী আকারের এক প্লেইট নূডলস্ এর দাম ৩ সিঙ্গাপুরী ডলার। তার অর্থ হলো প্রতি সিঙ্গাপুরী ডলার যদি ৮৫ টাকা হয় তবে এক প্লেইট নূডলস্ এর দাম বাংলাদেশি টাকায় হয় ৮৫x৩=২৫৫/- টাকা। বাংলাদেশে অবশ্যই পণ্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও এক প্লেইট নূডলসের দাম ২৫৫ টাকা হবে না। এক কাপ চায়ের দাম ২ সিঙ্গাপুরী ডলার। বাংলাদেশি টাকায় তা হবে ৮৫x২=১৭০/- টাকা। পাঁচ তারকা হোটেল বাদ দিলে বাংলাদেশে কোন জায়গায় এক কাপ চায়ের দাম ১৭০ টাকা হবে না। রাত্রে আমরা ৪ জন (আমি, আমার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে) একটি মাঝারী মানের হোটেলে ভাত খেতে ঢুকলাম। আমি রাত্রে ভাত খেতে চাই না বলে চাপাতি খেলাম। আমার স্ত্রী ও সন্তানরা সাদা ভাত, সবজি, ডাল খেয়েছে। বিল এসেছে ৩০ ডলার (SD)। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৩০x৮৫=২,৫৫০/- টাকা। বাংলাদেশে এ মানের খাবারে সর্বাধিক বিল আসতো ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। পরের দিন পড়ন্ত বিকালে টিফিন করা দরকার। ভাবলাম লিটল ইন্ডিয়াতে যখন যাবো সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে টিফিন করে নেবো। যথাসময়ে টেক্সি নিয়ে লিটল ইন্ডিয়াতে পৌঁছলাম। লিটল ইন্ডিয়া যে স্থানকে বলা হচ্ছে সেখানে তেমন কোন উচ্চ বিল্ডিং নেই। একটি রেস্টুরেন্ট পেলাম। রেস্টুরেন্টের নাম আবু আহম্মদ রেস্টুরেন্ট। ভদ্রলোক ইন্ডিয়া তামিল নাডু অঞ্চলের রুটি পরটা পেলাম। তাই মোট ৬টি পরটা, এক ডাল ও দুইটি ডিম (ডিমের ঝোল) দেয়ার আদেশ দিলাম অর্ডার লিস্ট দেখে। প্রতিটি পরটার দাম দেয়া আছে এক ডলার করে। তার মানে বাংলাদেশি টাকায় ৮৫ টাকা। এক প্লেইট ডিম (এক প্লেইটে ২টি ডিমের ঝোল) এর দাম দেয়া আছে ৫ ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ৮৫x৫=৪২৫/- টাকা। দুই কাপ চা খেয়ে মোট ১৫ ডলার দাম পরিশোধ করে বিদায় নিলাম। আরো অবাক করার ব্যাপার যে, রাত্রি’ ১১টার পরে কোন টেক্সি, এপস্ এর মাধ্যমে পাওয়া যায় না। শেষ দিন মোস্তফা মার্কেটে বাজার করতে করতে রাত ১১:০০টা বেজে যায়। ফলে হোটেলে আসার জন্য কোন টেক্সি পাচ্ছি না; সব টেক্সির মাথায় লাল আলোতে লিখা ‘OnCall’. আমাদের হোটেলের দূরত্ব মাত্র ১ মাইল মোস্তফা মার্কেট থেকে। অবশেষে ১১:৩০ মিনিটে একটি টেক্সিকে অনেক অনুরোধ করলে সে অবশেষে রাজি হয় ২০ ডলারের বিনিময়ে। অর্থাৎ এক মাইল পথ যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি টাকায় দিতে হয়েছে ৮৫x২০=১৭০০ টাকা। এভাবে তিন দিনের মধ্যে সব টাকা শেষ হয়ে গেলে সিঙ্গাপুর থেকে বিমানে মালয়েশিয়া রওনা হয়ে যাই। স্থানীয় সময় বেলা ৩:০০টায় মালয়েশিয়া পৌঁছে যাই। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের সাথে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার সময়ের ব্যবধান দুই ঘণ্টা। অর্থাৎ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ থেকে দুই ঘণ্টা সময় এগিয়ে থাকে।
যথাসময়ে আমরা মালয়েশিয়ার হোটেলে পৌঁছে যাই। কারণ আমাদের হোটেল আগেই রিজার্ভ করা ছিল। আমি বাংলাদেশ থেকে ১০০ রিঙ্গিত নিয়ে গিয়েছিলাম। খুব তাড়াতাড়ি সবাই একটু ফ্রেশ হয়ে স্থানীয় সময় বিকাল ৪:০০টায় বের হয়ে পড়ি। প্রথমে ভাত খাওয়ার জন্য আমাদের হোটেলের পাশে একটি মাদ্রাজী হোটেল পেলাম যেখানে ভাত থেকে আরম্ভ করে সব খাবার আছে। আমরা চার জনে মাত্র দুই প্লেইট ভাত নিয়েছি। কারণ আমাদের সন্দেহ ছিল মাদ্রাজী খাবার খেতে পারবো না। অবশ্য তা হয়নি। চার জনে মিলে স্বল্পপরিমাণ খাবার খেয়ে ১২ রিঙ্গিত, অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ২৫x১২=৩০০/- টাকা পরিশোধ করে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলে হাফ কিলোমিটার দূরে একটি শপিং মলে গেলাম। দেখলাম শপিং মলের ক্রিয়গত পদ্ধতি সিঙ্গাপুরের শপিং মলের ন্যায়। সিঙ্গাপুরে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার জন্য যেমন এপস্ এর মাধ্যমে টেক্সি রিজার্ভ করতে হয় তেমনি মালয়েশিয়াতেও একই। সিঙ্গাপুরে যেমন কোন গাড়িতে হরণ নেই তেমনি মালয়েশিয়াতেও কোন গাড়িতে হরণ নেই। সিঙ্গাপুরের ন্যায় মালয়েশিয়াতে রাস্তায় কোন বৈদ্যুতিক খুটি বা তার নেই। পানি নিষ্কাশনের বড় বড় নালাও নেই। সবচেয়ে বড় কথা, কোন ট্রাফিক পুলিশও রাস্তায় নেই। লাল বাতি জ্বলার সাথে সাথে শত শত গাড়ি (Car) সম লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। একটি গাড়ি থেকে অপর গাড়ির দূরত্ব থাকে প্রায় দশ হাত। এমনকি বাইকগুলোও আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করে না। একদিন রাত্রে মালয়েশিয়ার রাস্তায় এক পুলিশ অফিসারের দেখা পেলাম। তাকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। তার সাথে প্রায় পনের মিনিট কথা বলেছি এ সম্পর্কে। আমার সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল যে, আপনাদের শহরের রাস্তা এত পরিস্কার রাখা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? এর উত্তরে সে অফিসার বললো আজ থেকে বিশ বছর আগেও রাস্তা এবং অন্যান্য প্যালেস পরিস্কার রাখা সম্ভব ছিল না। সরকার সেই সময়ে একটি আইন করে। যে ব্যক্তি রাস্তায় ময়লা বা আবর্জনা বা কাগজ, প্লাস্টিক, থুথু ফেলবে সেই ব্যক্তিকে পুলিশ কর্তৃক তাৎক্ষণিক ৩০০ রিঙ্গিত জরিমানা করা হবে। প্রথম দিকে এই আইন প্রয়োগ করতে খুবই বেগ পেতে হয়েছে। পরবর্তীতে অবশ্য জাতি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া ছোট ছোট প্লাস্টিক বিন (ঝুড়ি) রাখা আছে নির্দিষ্ট দূরত্বে। সেখানে আবর্জনা ফেলা যায়।
শপিং মল থেকে কেনাকাটা সারতে সারতে প্রায় ৮:০০টা বেজে গেল। হোটেলের রুমে এসে সব শপিংকৃত পণ্য রেখে রাত্রের আহার করার জণ্য রওনা হলাম। হোটেলের দারোয়ানকে জিজ্ঞাস করে সেদিকে চার জন রওনা হলাম। কিছুদূর যেতেই সারিবদ্ধ রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলাম। আমার কাছে মনে হয় মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা বেশি। এখানকার লোকেরা খায়ও বেশি। একটি রেস্টুরেন্টে সুবিধামত টেবিলে বসে গেলাম। আরো অনেক লোক খাচ্ছে। মনে হলো অধিকাংশ লোক চায়নিজ। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম কেউ তেলাপোকা ভাজি, কেউ টিকটিকি ভাজি খাচ্ছে। আমার স্ত্রী বমি করার উপক্রম। তাড়াতাড়ি ঐ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করলাম চারজন। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর দেখলাম একটি সেলুনের বারান্দায় একজন বাঙালী চেহারার লোক বসে আছে। তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞাস করলাম তিনি বাংলাদেশি কিনা? সুন্দর বাংলায় উত্তর দিল তিনি বাংলাদেশি। তার বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। তাকে আমাদের দুঃখের কথা বললাম এবং একটি বাঙালি রেস্টুরেন্টের সন্ধান চাইলাম। বললাম ‘ভোজন বিলাস’ নামক একটি রেস্টুরেন্টের নাম আমি ইউটিউবে দেখেছি। সে বলল, এ স্টেুরেন্টটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে ‘রাঁধুনি বিলাস’। সে আমাদেরকে ‘রাঁধুনি বিলাসে’ নিয়ে গেল। বাঙালি এ হোটেলের প্রায় সব ভোক্তা বাঙালি। এতক্ষণ পর হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। হাত, মুখ ধূয়ে দুইজনের জন্য ইলিশ মাছ, আমার ছেলের জন্য মুরগি ও মেয়ের জন্য সবজির অর্ডার দিলাম। খাওয়ার পরে দুই কাপ চাও নিলাম। আমাদের বিল আসলো ৯০ রিঙ্গিত। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় তা হয় ৯০x২৫=২২৫০/- টাকা। এরূপ মেনু দিয়ে বাংলাদেশে যে কোন মধ্যম শ্রেণির রেস্টুরেন্ট খাওয়ার বিল কখনো ২২৫০/- টাকা আসবে না। অবশ্য পরবর্তীতে মাদ্রাজী একটি পরিপাটি রেস্টুরেন্টের সন্ধান পেয়েছি যেখানে মুরগী, সবজি (চার প্রকারের) দিয়ে ভাত খেলে সর্বোচ্চ আসতো ৪০ রিঙ্গিত যা বাংলাদেশি টাকায় ৪০x২৫=১০০০/- টাকা। এটাও বাংলাদেশের ঐ মানের রেস্টুরেন্টের বিলের তুলনায় অধিক। বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মধ্যে যদি পণ্য মূল্যের তুলনা করা হয় তবে দেখা যাবে বাংলাদেশে পণ্য মূল্য তুলনামূলক কম। যদিও এদেশে পণ্য মূল্য আরো কম ছিল। তবে কেন এদেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোগান্তি হচ্ছে? এর প্রধান কারণ এদেশের জনগণের মাথাপিছ আয়ের সম বণ্টন হচ্ছে না। মাথাপিছু আয়ের বৃহৎ একটি অংশ সমাজের এক শ্রেণির লোক হস্তগত করছে। ব্যাংকে খাঁড়ি খাঁড়ি টাকা জমা রাখছে অথবা সম্পদের পাহাড় গড়ছে অথবা বিদেশে টাকা পাচার করেছে। অপরপক্ষে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে ক্রমক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। যার কারণে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ লোক পণ্য মূল্য বৃদ্ধিতে কষ্ট পাচ্ছে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি