ক্রমাগত বাজার চাহিদা কমে যাওয়া এবং উপকরণের দর বৃদ্ধির কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন লাল সেমাই কিংবা বাংলা সেমাইয়ের কারখানার মালিকরা। লোকসান সামাল দিতে না পেরে অনেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গত পাঁচ বছরে নগরীর চাক্তাই-রাজখালীর অর্ধেক কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় লোকসান কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারলেও চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ে মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বলে জানা যায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলা সেমাইয়ের প্রচলন প্রধানত ঈদনির্ভর। ঈদে অতিথি এলে একসময় বাংলা সেমাই দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। তবে সময়ের সাথে সাথে উচ্চবিত্ত লোকজন বাংলা সেমাই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। মধ্যবিত্তের ঘর থেকেও প্রায় চলে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলা সেমাইয়ের জায়গা নিয়েছে বাহারি মোড়কের লাচ্ছা সেমাই। তাই গত ৫ বছরে বাংলা সেমাই ৭০ শতাংশ বাজার হারিয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে লকডাউনের কারণে পরিবহন বন্ধ থাকার কারণেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সেমাই কিনতে আসতে পারেনি। এছাড়া ময়দার দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচের সাথে বর্তমান বাজার মূল্যের ফারাক দেখা দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি ৩৫ কেজি টুকরিতে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
গতকাল চাক্তাই-রাজাখালীর কয়েকটি সেমাইয়ের কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, কারখানার শ্রমিকেরা বাঁশে সেমাই ঝুলিয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। অনেকে সেমাই তৈরির খামি আগুনে দিচ্ছেন। রোদে ভালোভাবে সেমাই শুকানো শেষে তেলে ভাজার পরে প্রস্তুত করা হচ্ছে সেমাই। এখন খোলা সেমাইয়ের চাহিদা কমার কারণে অনেকে খোলা লাচ্ছা সেমাই তৈরির দিকে ঝুঁকছেন। তবে বাজারের প্যাকেটজাত লাচ্ছা সেমাইয়ের কাছে বারবার বাজার হারাচ্ছেন কারখানা মালিকরা।
জানা গেছে, চাক্তাই ও রাজাখালীতে একসময় আমরিন সেমাই, সোনার মদিনা সেমাই, জমজম সেমাই, আঙুর ব্র্যান্ড, হরিণ ব্র্যান্ড, ভাই ভাই ব্র্যান্ড, কেবি ব্র্যান্ড, দুই আমসহ আরো কিছু কারখানা সেমাই উৎপাদন করত। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক কারখানা মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কারখানার সংখ্যা কমার পাশাপাশি কমেছে সেমাইয়ের দামও। বর্তমানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩৫ কেজির টুকরি সেমাইয়ের দাম পড়ছে ৯৭০ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, যা তিন মাস আগের তুলনায় ৩০০ টাকা পর্যন্ত কম। কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, আগে যেখানে কারখানাগুলো দৈনিক গড়ে একশ মণ করে উৎপাদন করত, এখন সেটি কমে এসেছে মাত্র ২০-২৫ মণে। অন্যদিকে ময়দার দামও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
চাক্তাই-রাজাখালীর কারখানা মালিকরা বলছেন, একসময় বাংলা সেমাইয়ের জয়জয়কার অবস্থা ছিল। কালের পরিক্রমায় এই সেমাই এখন কদর হারিয়েছে। চাক্তাই-রাজখালী এলাকায় আজ থেকে ২০ বছর আগেও ৪০টির বেশি সেমাই কারখানা ছিল। পর্যায়ক্রমে বন্ধ হতে হতে এখন উৎপাদন করে মাত্র ১২-১৪টি কারখানা। যেসব কারখানা উৎপাদনে রয়েছে তারাও আবার খুব একটা ভালো নেই। বিভিন্ন নামীদামি ব্র্যান্ড এখন আকর্ষণীয় মোড়কে সেমাই বাজারজাত করছে। বাংলা সেমাইয়ের বাজার একসময় ১০-১৫ কোটি পর্যন্ত ছিল। তবে এখন মাত্র দুই কোটিতে নেমে এসেছে। এখন মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। তাই লাল সেমাই নিম্নবিত্তের খাবার হয়ে আছে। তবে কিছু কিছু মধ্যবিত্ত পরিবার অভ্যাসগত কারণে এই সেমাইটি কিনেন। তা-ও পরিমাণে অল্প পরিমাণে। বলা যায়, আধুনিক লাচ্ছা সেমাইয়ের কাছে বাজার হারিয়ে বাংলা সেমাইয়ের কারখানাগুলো বন্ধ হতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া অনেক কারখানা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রেখে কারখানা চালাতে পারেনি। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরির কারণে প্রশাসনের অভিযানে কারখানা সিলগালার পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়। এটিও কারখানা বন্ধ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল।
চাক্তাইয়ের পাঞ্জা ব্র্র্যান্ডের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলা সেমাই তৈরির কারখানাগুলো গত কয়েক বছর ধরে কোনোমতে টিকে আছে। তবে বর্তমানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে একেবারে ধস নেমেছে। সেমাই উৎপাদন কিছুটা প্রকৃতির ওপরও নির্ভরশীল। বৃষ্টি হলে সেমাই শুকানো যায় না, তাই সেই সময় বাধ্য হয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। গ্রাম বাংলায় এখনো বাংলা সেমাইয়ের চাহিদা রয়েছে। চাহিদা থাকলেও পরিবহন সংকটের কারণে পণ্য পাঠাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
রাজাখালীর মেসার্স সানোয়ারা সেমাই ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আজগর আজাদীকে বলেন, আমাদের সেমাইয়ের ব্র্যান্ডের নাম ‘সূর্য’। গত বছর করোনার মধ্যেও বাংলা সেমাইয়ের বেচাবিক্রি খুব একটা খারাপ হয়নি। কিন্তু এ বছর করোনায় দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর থেকে কারখানা মালিকদের এক প্রকার পথে বসার অবস্থা। আমার কারখানা গত তিন দিন ধরে বন্ধ। আমাদের কাছে এখন যে পরিমাণ সেমাই মজুদ আছে সেই তুলনায় বিক্রি নেই। গত বছর ত্রাণ হিসেবে গরিব মানুষদের অনেকে বাংলা সেমাই দিয়েছেন। এ বছর সে ধরনের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা পরিবহন সমস্যার কারণে সেমাই কিনতে আসতে পারেনি। তাই সেমাইয়ের বাজার আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে।