বাঁধগুলোর অপসারণ কবে?

প্রায় সব খালেই মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান পানি আটকে গেলে তাৎক্ষণিক কেটে দেয়া হবে : প্রকল্প পরিচালক

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১ জুন, ২০২১ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

কিছুদিন ধরে শহরজুড়ে আলোচনার তুঙ্গে আছে ‘বাঁধ’ প্রসঙ্গ। বৃষ্টি এলে জোরালো হয় সেই আলোচনা। নগর পিতা থেকে সাধারণ নাগরিক, সবাই কথা বলছেন বাঁধ নিয়ে। শহরের বিভিন্ন খালের ৩০টির বেশি স্পটে আছে এ বাঁধ। জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের কাজের সুবিধার্থে বাঁধগুলো দেয়া হয়েছে। তাই আলোচনার সাথে প্রকল্প গৃহীতা সিডিএর সমালোচনা করতে ছাড়েন না নগরবাসী। বাঁধগুলো অপসারণ করতে সিটি মেয়র একাধিকবার অনুরোধ করেন সিডিএকে। দফায় দফায় বৈঠকও হয়েছে সিডিএ-চসিকের মধ্যে। সর্বশেষ গত রোববার একটি সভা থেকে ১৫ দিনের মধ্যে বাঁধ অপসারণের আল্টিমেটাম দেন মেয়র। এরপরও বাঁধগুলো অপসারণে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা শুরু হয়নি।
এ অবস্থায় সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, ভারী বৃষ্টি হওয়ার আগেই বাঁধগুলো অপসারণ হবে? নাকি এবারো জলাবদ্ধতার কারণ হয়ে ওঠবে বাঁধগুলো? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, আপাতত বাঁধগুলো অপসারণের কোনো পরিকল্পনা নেই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। বরং চলতি জুন মাসের পুরোটাই বাঁধগুলো বহাল রাখার পরিকল্পনা আছে। অবশ্য আবহাওয়া অধিদপ্তর কর্তৃক ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস মিললে অপসারণ করা হবে। এক্ষেত্রে একদিন বৃষ্টি হলে এবং এরপর টানা কয়েকদিন বৃষ্টি না হওয়ার পূর্বাভাস থাকলেও অপসারণ করা হবে না। তবে যে দিন ভারী বৃষ্টি হবে ওইদিন পানি যাওয়ার জন্য বাঁধের কিছু অংশ সাময়িকভাবে খুলে দেয়া হবে। পুনরায় দেয়া হবে বাঁধ।
বাঁধ দেয়ার কারণ :
মেগা প্রকল্পের আওতায় চলছে খালের দুই পাড়ে ১৭৬ কিলেমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ। এর মধ্যে ১০৬ কিলোমিটারের কাজ চলমান আছে। যেখানে যেখানে কাজ চলমান সেখানে বাঁধ দেয়া হয়েছে। আবার প্রকল্পের আওতায় বালি আটকাতে ৪২টি সিল্ট ট্রাপের মধ্যে ১৫টির কাজ চলমান আছে। সেখানেও বাঁধ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কয়েকটি খালে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। তার জন্যও বাঁধ দেয়া হয়েছে। বাঁধের পাশাপাশি অনেক খালের মাঝখানে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এতেও খালের প্রশস্ততা কমে গেছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি প্রবাহে। অবশ্য যেখানে বাঁধ আছে সেখানে পাইপ দিয়ে পানি যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
যেখানে বাঁধ আছে :
সরেজমিন পরিদর্শন ও মেগা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, চাক্তাই খালের চারটি পয়েন্টে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য বাঁধ ও খালের মাঝখানে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। হালিশহরের নাছির খালের চারটি পয়েন্টেও বাঁধ দিয়ে কাজ চলছে। এছাড়া হিজরা খালের পাঁচলাইশ জাতিসংঘ পার্ক এলাকায় কালভার্ট নির্মাণের জন্য বাঁধ দেয়া হয়েছে। মহেশখালে খালের মাঝখানে রাস্তা করা হয়েছে। এছাড়া গয়নাছড়া খাল, রাজাখালী খাল, ডোমখালি খাল, চশমা খাল, মরিয়ম বিবি খাল ও ফিরিঙ্গিবাজার খালেও বাঁধ দেয়া হয়েছে।
এদিকে গয়নাছড়া খাল, তুলাতুলি খাল, মোজাফ্‌ফারাবাদ, টাইগারপাস, মোগলটুলি, পাহাড়তলীসহ ১৫ জায়গায় সিল্ট ট্রাপ নির্মাণে বাঁধ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) গৃহীত ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পটি ৫ হাজার ৬শ ১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল। ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিডিএর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। একই বছরের ২৮ এপ্রিল নগরীর চশমা খাল ছাড়াও মুরাদপুর এলাকার সুন্নিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন খাল ও বহদ্দারহাট মোড়ের বড় নালা পরিষ্কার করার মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল।
বাঁধ অপসারণের দাবি জোরালো হচ্ছে :
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বার বার বাঁধ ও খালের মাঝখানে দেয়া রাস্তা অপসারণের কথা বলে আসছেন। বাঁধের কারণে একদিকে জলাবদ্ধতার শঙ্কা এবং অন্যদিকে স্থির পানিতে মশার প্রজননের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। গত ১৪ মার্চ টাইগারপাসস্থ সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী কার্যালয়ে চসিক মেয়র ও সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ সমন্বয় বৈঠক করেন। সেখানেও বাঁধ অপসারণের আহবান করেন মেয়র। দুজনের আলোচনার প্রেক্ষিতে সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএর প্রকৌশলীরা যৌথভাবে খালের বাঁঁঁধগুলো পরিদর্শন করে কয়েকটি পয়েন্টে দ্রুত বাঁধ অপসারণের সুপারিশ করেন।
গত ঈদ-উল ফিতরের দিন মাত্র এক ঘন্টার বৃষ্টিতে তীব্র জলাবদ্ধতা হয় নগরে। ওইদিন অনেক নিচু এলাকায় ১৩ ঘন্টা পর্যন্ত পানি আটকে ছিল বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। এরপর সিটি মেয়র পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বাঁধ অপসারণের আহবান করেন। তিনি সিডিএ চেয়ারম্যানকে ফোন করেও পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেন। সর্বশেষ গত রোববার অনুষ্ঠিত নগরের খালের দুই পাড় থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও মনিটরিংয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গঠন করে দেয়া টাস্কফোর্স সভা থেকেও পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বাঁধ অপসারণের দাবি এসেছে।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, দ্রুত বাঁধ কেটে দিতে হবে। অন্যথায় ভারী বৃষ্টি হলে শহর ডুবে যাবে। বৃষ্টি হলে পানি হবে। কিন্তু পানি যাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে তো। বাঁধগুলো যদি ক্লিয়ার থাকে তাহলে মানুষকে কষ্ট পেতে হবে না। দ্রুত পানি নেমে যাবে।
বাঁধগুলো কখন অপসারণ করা হবে :
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী আজাদীকে বলেন, আমরা প্রত্যেক সপ্তাহে বৃষ্টি কখন হবে না হবে তার পূর্বাভাস সংগ্রহ করি। তার প্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করি। পূর্বাভাস দেখে বৃষ্টি শুরু হবে বুঝতে পারলে এক সপ্তাহ আগে বাঁধ খুলে দিবো। গত বছর আমরা ২০ জুলাই সকল বাঁধ অপসারণ করেছিলাম। এ বছর এখন পর্যন্ত বৃষ্টির যে অবস্থা তাতে পুরো জুন মাস কাজ করতে পারবো বলে ধরে নিচ্ছি। ততদিন বাঁধও থাকবে। যদি আগেভাগে কন্টিনিউ বৃষ্টি শুরু হয় তাহলে তখনি অপসারণ করবো। তবে যদি দেখি একদিন বৃষ্টির পর সাত দিন হবে না বা একদিন হয়ে ১০ দিন হবে না তাহলে কাজ চলমান থাকবে। বাঁধও থাকবে। তা না হলে কাজের পর্যাপ্ত অগ্রগতি হবে না। কারণ, প্রকল্পের কাজ শুধুমাত্র শুষ্ক মৌসুমে করা যায়। ১২ মাস প্রচার হলেও নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত আট মাস কাজ করার সুযোগ পাই। সুতরাং যতক্ষণ সুযোগ থাকবে ততক্ষণ কাজ করে যেতে চাই।
কোথায় কোথায় বাঁধ আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় সবগুলো খালেই কাজ করছি এবং সেখানে বাঁধ আছে।
বৃষ্টি শুরু হলে একসঙ্গে সবগুলো বাঁধ অপসারণ সম্ভব কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, যেখানে যেখানে কাজ চলছে সেখানে স্কেভেটর রাখা আছে। বৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিকভাবে কেটে দিচ্ছি। পানি চলে গেলে আবার বাঁধ দিয়ে কাজ করছি। সুতরাং পানি আটকে যাবার মতো পরিস্থিতি হবে না। বাঁধ থাকা মানেই পানি আটকে যাবে তা না। সেখানে পাইপ দিয়ে পানি যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। তারপরও আটকে যাবার মতো পরিস্থিতি হলে তাৎক্ষণিক কেটে দিচ্ছি। তাহলে ঈদের দিন জলাবদ্ধতা হয়েছে কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঈদের দিন ঠিকাদারের লোকজনও ছিল না। সাইডে লোক ছিল না। এখন কিন্তু সব লোক চলে আসছে। সমস্যা হবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআদালতে মুছাপত্নীর জবানবন্দি
পরবর্তী নিবন্ধওয়াসার পানিতে হঠাৎ বেড়েছে লবণাক্ততা