বহুমাত্রিকতায় অনন্য হুমায়ূন আহমেদ

কুমুদিনী কলি | বৃহস্পতিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

আয়োজন করে গল্প লিখতে বসেছি। এক বৈঠকে গল্প শেষ করব এই কারণেই আয়োজন। বল পয়েন্টের প্যাকেট, কাগজ, চায়ের কাপ, সিগারেটের প্যাকেট হাতের কাছে। বল পয়েন্টের প্যাকেট নিয়ে বসেছি, কারণ কলমগুলো এমন যে সামান্য লিখলেই কালি আটকে আসে।

আমার স্বভাব যে কলমে একবার কালি আটকালো সে কলম দূরে ছুঁড়ে ফেলা। লেখার কাগজের ব্যাপারেও আমার কিছু সৌখিনতা আছে। খুব দামী কাগজে লিখতে পছন্দ করি। যখন হত দরিদ্র অবস্থা ছিলো তখনও রেডিও বন্ড নামের কাগজ ব্যবহার করতাম।

অমৃত ধারণ করতে হয় স্বর্ণভান্ডে, মাটির হাঁড়িতে না।

লেখা আমার কাছে ‘অমৃতসম’।”

বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া প্রজন্মকে বইমুখী করেছিলেন যে যাদুকর, তিনি হুমায়ূন আহমেদ। তিনি তাঁর যাদু ছড়িয়ে দিলেন বাংলা গদ্য সাহিত্যের আনাচেকানাচে। লেখাকে অমৃতসম মনে করে তাকে উপজীব্য করে জীবনযাপনের সিদ্ধান্তে ত্যাগ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো আকর্ষণীয় পেশা।

রবীন্দ্র নজরুল বলয় ত্যাগ করে উদীয়মান পঞ্চপান্ডবের নতুন সৃষ্টি করা সাহিত্যরেখা ডিঙিয়ে, বিশ শতকের বেশ গুরুত্বপূর্ণ কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি অগ্রগামী। অত্যন্ত প্রখর মেধাবী এই লেখক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর মেধার পরিচয় দিয়েছেন।

প্রথম জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা এই লেখক পত্রিকার পাতায় নিয়মিত লিখতেন। হঠাৎই অধ্যাপনার পাঠ চুকিয়ে শুরু করলেন চলচ্চিত্র নির্মাণ।

আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ছবি বানানো চলছেই একের পর এক।

ফাঁকে ফাঁকে টিভির জন্য নাটক বানানো। এছাড়াও গল্প, উপন্যাস, পত্রিকার ধারাবাহিক লেখা। সবমিলে বৃহস্পতি একেবারে তুঙ্গে।

এই তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা ত্রিশ বছর ধরে চলমান। বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে তিনি এক প্রবাদ পুরুষে পরিণত হলেন জীবিতাবস্থায়।

বইমেলায় লাইন ধরে অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা পাঠক পাঠিকার সংখ্যা এবং উপচে পড়া আগ্রহ দেখে না বোঝার উপায় নেই তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন।

হুমায়ূন আহমদ সেই জাদুকর, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ঝিমিয়ে পড়া সাহিত্যজগতে হঠাৎই প্রাণের জোয়ার এনেছেন। সেই জোয়ারে গা ভাসিয়েছে এদেশের বই বিমুখ মানুষ। শিশু থেকে তরুণ সবাই তাঁর বই পড়ছে।

একই লেখক সবার মন ছুঁতে পারছে তাঁর লেখার মাধ্যমে। এটা জাদু বৈ অন্য কিছু নয়।

তাঁর গল্প বলার মধ্যে এমন এক অসাধারণ যাদুকরী ক্ষমতা ছিলো, আর ছিলো নিজস্ব এক মোহনীয় নির্লিপ্ত ভাষা। তাতে পাঠক প্রথম লাইনেই সেখানে আটকে যেতো তাঁর সহজ সরল ভাষায় আকর্ষণীয় গল্পের শেষ পর্যন্ত শুনতে।

গল্প বলার বা বানাতে পারার অসাধারণ দক্ষতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের কালপুরুষ হিসেবে তৈরী হতে সাহায্য করেছে। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর মতো গল্পকার আর কয়জনই বা পাওয়া যায়!

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির মূল উপজীব্য বিষয় ছিলো বাঙালি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনসংকট। তিনি তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্প উপন্যাসে এই শ্রেণিকে তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন তাদের জীবন সংগ্রামের বিভিন্ন দিক।

তাঁর বেশিরভাগ গল্প উপন্যাস যদিও নগরকেন্দ্রিক, কিন্তু তিনি গ্রামীণ সমাজ ও জনপদকেও সমান দক্ষতা দিয়ে মূর্ত করে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যে।

তিনি লোকজ কল্পকাহিনি ও ঐতিহাসিক রাজা রাজরার গল্প নিয়ে ও সাহিত্য রচনা করেছেন। আর সেসব লোকজ কাহিনি তুলে আনতে গিয়েছেন নানা জায়গায়।

তিনি দেশেবিদেশে প্রচুর ঘুরে বেরিয়েছেন। যেখানেই গেছেন, সেখান থেকেই তুলে এনেছেন সেখানকার সারতত্ত্ব। আর সেসবকে উপজীব্য করে তৈরী করেছিলেন তাঁর উপন্যাস, গান, নাটক, গল্প। তাঁর ভ্রমণ বিষয়ক বহু গল্প, ভ্রমণোপাখ্যানগুলোও বেশ জনপ্রিয়। তিনি বেশ বই পড়তেন। এক্ষেত্রে তাঁর তেমন বাছ বিচার ছিলো না। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ তাই প্রমাণ করে। নিজ ধর্ম ছাড়াও ভিন্ন ধর্ম নিয়ে ও তাঁর সমান আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাঁর এক বইয়ে বিবেকানন্দের বাণী তুলে ধরেছেন। তেমনি তাঁর নিজ ধর্ম ইসলামকে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জায়গায় তুলে ধরেছেন স্বমহিমায়। ইসলামের বিভিন্ন সুরা, আয়াত, নামাজ ও নবী রাসুলের বিভিন্ন কাহিনি, কোরআন নাজিল হওয়ার কথা, তাহাজ্জুদের মহিমা, সে পবিত্র সময়ের স্নিগ্ধতার কথা প্রভৃতিতে স্রষ্টার প্রতি তাঁর যে নিরন্তর সমর্পণ তা ফুটে উঠেছে অবলীলায়। তাঁর প্রতিটি সাহিত্যকর্মে তিনি তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার নিদর্শন রেখেছেন।

রবীন্দ্রনাথকে আজীবন পাঠ করে এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনি প্রভৃতির নামকরণে তা লক্ষ্যণীয়। উৎসর্গপত্রে, কাহিনির প্রয়োজনে, বিভিন্ন চরিত্রের মুখে অনায়াসে তিনি রবীন্দ্র ভাবনা প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরেছেন। তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মের প্রতি পরতে পরতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথকে মন ও মননে ধারণ করা তাঁর সমৃদ্ধ সাহিত্যিক সত্তার বিশেষ দিক বলে মনে হয়।

সমরেশ মজুমদার একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশের বইমেলার কথা মনে পড়তেই তিনি হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে পান। সারি সারি ছেলেমেয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফের জন্য অপেক্ষমাণ। একজন লেখকের জন্য এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!

এছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন লেখক তাঁর সাহিত্যিক জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। ব্যক্তি হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সৃষ্ট চরিত্র হিমু এবং মিসির আলীর মতোই সদা রহস্যময়। তাঁর তৈরী করা সাধারণ চরিত্রগুলোকে তিনি সাধারণ ভাষায় অসাধারণ ভাবে বর্ণনা করেছেন, আর তাতেই হিমু বা মিসির আলী আর চরিত্র হয়েই থেমে থাকেনি, তারা প্রাণ পেয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর পাঠকসমাজে।

তাঁর লেখনী দেশের আপামর জনসাধারণের আবেগ, অনুভূতি, জীবনযাপন, কল্পনাশক্তিকে স্পর্শ করেছিলো বলেই বাংলা সাহিত্যে এমন এক ধারা তৈরী হলো তাঁর হাত ধরে, যা এখনও পাঠকের মন দখল করে আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় হিমু বা মিসির আলী বা বাকের ভাই আধপাগল অথবা অগোছালো চরিত্র। কিন্তু তারা আমাদের অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি।

হিমু’ চরিত্রটি বাস্তব ও অলৌকিকতার মাঝামাঝি এক রহস্যময়তা ধারণ করে। ময়ূরাক্ষী, হিমু সমগ্র, হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম প্রভৃতিতে হিমু চরিত্রের এত সুন্দর বর্ণনা হিমুকে হুমায়ূন আহমেদের প্রতীকে পরিণত করেছে। হলুদ পাঞ্জাবি পরা এলোমেলো, অগোছালো চুলের হিমু এখনও হুমায়ূন ভক্তদের মাঝে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে স্বমহিমায়।

এক রহস্যময়, যুক্তিবাদী ও মনোবিজ্ঞানী যে অতিপ্রাকৃত ঘটনা নিয়ে গবেষণা করে, মিসির আলী তেমনই এক চরিত্র। দেবী, মিসির আলী সমগ্র, নিশীথিনী অতিপ্রাকৃত ঘটনায় একদম ঠাসা।

তাঁর জনপ্রিয় নাটকগুলো সে সময়কার শ্রেষ্ঠত্বের তকমা পেয়েছিলো। এতটা জনপ্রিয় নাটক এই সময়ের প্রেক্ষাপটে ও এখনও আর নির্মিত হয়নি। এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার তাঁর মধ্যে অন্যতম।

কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাই চরিত্রটি এযাবৎকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। এখনো পর্যন্ত এই চরিত্রকে ডিঙিয়ে অন্য কোনো চরিত্র বাংলা নাটকে চোখে পড়েনি। তাঁর কল্পনাশক্তি অত্যন্ত প্রখর। আর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। তিনি তাঁর কল্পনায় অনেকদূর যেতে পারতেন, এটি তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা।

তিনি বলেছেন, ‘ময়ূরাক্ষী নদীকে একবারই আমি স্বপ্নে দেখি। নদীটা আমার মনের ভেতর পুরোপুরি গাঁথা হয়ে যায়। এরপর অবাক হয়ে লক্ষ্য করি কোথাও বসে একটু চেষ্টা করলেই নদীটা আমি দেখতে পাই। তার জন্য আমাকে কোনো কষ্ট করতে হয় না। চোখ বন্ধ করতে হয় না,কিছু না। একবার নদীটা বের করে আনতে পারলে সময় কাটানো কোনো সমস্যা নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি নদীর তীরে হাঁটি। নদীর হিমশীতল জলে পা ডুবিয়ে বসি। শরীর জুড়িয়ে যায়। ঘুঘুর ডাকে চোখ ভিজে ওঠে।’

এমন অজস্র অনুভূতি তিনি কল্পনায় তৈরী করতেন। আর তা তাঁর বর্ণনায় কল্পনাকে ছাপিয়ে এমন ভাবে বাস্তবের সাথে মিলে মিশে যেতো, তখন শুধু মুগ্ধতার পাল্লা ভারী হতো। পাঠক তার অবচেতন মনে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতেন সেই অনুভূতির সাথে। লেখকের সাথে পাঠকের এমন নিবিড় যোগাযোগ বাংলা সাহিত্যে আর কখনো হয়েছে কি?

চাঁদ ও জ্যোৎস্নার সাথে এক নিবিড় সম্পর্ক ছিলো তাঁর। তিনি জ্যোৎস্না পাগল লোক ছিলেন। তাঁর গানে, গল্পে, উপন্যাসে প্রায় প্রতিক্ষেত্রে তিনি জ্যোৎস্নার উল্লেখ করতেন।

এই যেমন কোথাও লিখলেন, ‘তারা হাঁটছে। পায়ের নিচে নদী। মাথার ওপর অন্য এক রকম আকাশ। চারপাশে থৈ থৈ জোছনা। যে জোছনা মানুষকে পাল্টে দেয়। যে জোছনায় সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বলে ভ্রম হয়।’

অনেক অনেক বিখ্যাত গানের গীতিকার তিনি। তাঁর নানামুখী পরিচয়ের বহুল প্রচার তাঁর গীতিকার পরিচয়কে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে।

হুমায়ূন আহমেদ কেবল একজন লেখক নন, বরং একটি যুগ, যা কখনোই ম্লান হবে না। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। তাঁর যাদুকরী ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হয়েছে সাহিত্যের সবকটি ক্ষেত্র। হুমায়ূন আহমেদ একটি বিশাল যুগ। তাঁকে নিয়ে বলা শেষ হয় না কখনো। সে পথ শুধুই চলার, থামিয়ে দিয়েছিলেন স্রষ্টা নিজেই। আরো দীর্ঘ জীবন লাভে সমৃদ্ধ হতো বাংলা সাহিত্য। তবে তা আর হয়নি।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনুষ্যত্বের সঙ্গ
পরবর্তী নিবন্ধযানজট ও জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ চাই