বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ১০ মে, ২০২১ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

মানুষ মরে যায় রেখে যায় স্মৃতি
করোনার ২য় ডোজের টিকা নিয়ে আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছি। ৩ মে আমার দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেওয়ার নির্ধারিত তারিখ ছিল। কিন্তু ঐ তারিখে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে আমার কাছে কোন মেসেজ আসেনাই। ৪ মে আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের টিকাদান কেন্দ্রে টিকা দিতে গিয়ে ফেরত আসি। এখন মেসেজ ছাড়া টিকা দিচ্ছে না। গণমাধ্যম জানিয়েছে প্রায় ১৫ লক্ষ টিকার ঘাটতি রয়েছে। যদি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে কেনা টিকা পাওয়া না যায় তাহলে বাংলাদেশে ১ম ডোজ টিকা গ্রহণকারীদের ২য় ডোজ কিভাবে দেওয়া হবে? হঠাৎ করে ভারতে করোনার বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় সে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কাছ থেকে সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা সরবরাহের জন্য চাপের মধ্যে পড়েছে। ভারত তার দেশে ১৮ বছর বয়সের বেশি নাগরিকদের গণহারে টিকা দেওয়া শুরু করেছে। তাদের নিজেদের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ভারতে করোনার সংক্রমণের হার বিশ্বের সর্বোচ্চ। সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা উৎপাদন করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আমরা সেরাম থেকে মোট ১ কোটি ২ লক্ষ টিকা পেয়েছি। বাংলাদেশে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় আমাদের সরকার দক্ষতার সাথে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিল। ভারতে যে করোনার বিপর্যয় হবে তা কে জানতো? হয়তো সেজন্য রাশিয়া বা চীন থেকে টিকা আনার বিকল্প উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নাই। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যে এই দুই দেশ থেকে পর্যাপ্ত টিকা আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এমনকি স্পুটনিক টিকা বাংলাদেশে উৎপাদন করা নিয়েও রাশিয়ার সাথে কথাবার্তা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ থেকেও টিকা আনার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের ১ম ডোজ টিকা গ্রহণকারীরা একটু দেরিতে হলেও ২য় ডোজের টিকা সবাই পাবেন বলে আমি মনে করি। আল্লাহ্‌র কাছে শুকরিয়া, আমি এবং আমার পরিবারের দুই সদস্য গত ৬ মে ২য় ডোজের টিকা নিতে পেরেছি। এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছে স্বরূপ দত্ত রাজু। সাবেক চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আমি টিকা নিতে পেরেছি কিনা সে ব্যাপারে মদিনা থেকে টেলিফোনে খোঁজখবর নিয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবিরের কাছে আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে তিনি আমাকে সহানুভূতি না দেখালে আমি এতো সহজে ২য় ডোজের টিকা পেতাম না।
সাখাওয়াত হোসেন মজনু’র মৃত্যু সংবাদটি শুনে আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়েছি। আমার নিজের অসুস্থতার কারণে আমি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাইনা। ১মে বেলা এগারোটার দিকে আমার এক ঘনিষ্ট লোক আমাকে ফোন করে বলে, আপনার কাছে কি মজনু’র কোন খবর আছে? আমি বললাম না। উনি বললেন ফেসবুকে লিখেছে মজনু ষ্ট্রোক করে মারা গেছে। আমি এই সংবাদ শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। রাশেদ রউফ এবং আবু তালেব বেলালকে ফোন করি। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, মজনু’র জ্বর হয়েছিল। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সে মারা যায়। বছর খানেক ধরে তার সাথে আমার যোগাযোগ ছিলোনা। ২০১৯ সালের ২ আগস্ট থেকে আমি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি শুরু করি। তখন শুনেছিলাম মজনু হার্ট অপারেশনের জন্য ইতিপূর্বে ভারতে গেছে এবং সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে। আমি ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমার বাসায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে আঘাত পাই। মাথা এবং চোখে আঘাতের কারণে আমাকে ভারতে গিয়ে অস্ত্রোপচার করাতে হয়। তারপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার ফলোআপের জন্য ভারতে গেলেও তারপর থেকে করোনা, সাধারণ ছুটি, কড়া বিধিনিষেধ, লকডাউনের জন্য আমি ভারতে গিয়ে ফলোআপ করাতে পারিনি, এমনকি দেশেও চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তার উপরে করোনার ভয়তো আছেই। এর মধ্যে আমার সাথে মজন’ুর যোগাযোগ হয়নি। এভাবে মজনু’র মৃত্যু হবে সেটা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। যে কারো সাথে আমার কথাবার্তা হলে আমি তাঁকে বলি, হয়তোবা এটাই তোমার সাথে আমার শেষ আলাপ। দ্বিতীয়বার তোমার সাথে যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম। পত্রিকায় লেখা পাঠানোর সময় রাশেদ রউফকে বলি, হয়তো এটাই আমার শেষ লেখা। অনেক লিখেছি, যখন অসুস্থ হয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছি না তখন কেউ খবর নেয়নি, কেউ মনে রাখেনি। আমার সবসময় মনে হয় মৃত্যু আমার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। রাশেদ চিন্তিত হয়ে আমাকে বলে, স্যার ও-কথা বলবেন না।
অসুস্থ অবস্থায় আমার একদিন বন্দর থানা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল আলমের কথা মনে পড়ে। আমি যখন ছাত্র রাজনীতি করি তখন সে আমার বিশ্বস্ত কর্মী ছিল। পরবর্তীতে সে চসিকের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়েছিল। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে আমি তাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাওয়ার জন্য বলেছিলাম। কিন্তু সে সাহস দেখায়নি। খোরশেদ আলম সুজন আওয়ামী লীগের যোগ্য প্রার্থী ছিল চট্টগ্রাম-১১ আসনে। সুজনকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়ায় আমি খুশি হয়েছিলাম এইজন্য যে, আসনটি একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদকে এমপি হিসেবে পাবে। আমাদের এই আসনে লিয়াকতও এমপি হয়েছিল। যে নির্বাচনী এলাকায় বন্দর, কাষ্টম, ইপিজেডের মতো সংস্থা রয়েছে সেখানে একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদকে এমপি পদের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারটি রাজনৈতিক দলগুলো কেন চিন্তাভাবনা করছেনা তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। সেদিক থেকে পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ হিসেবে সুজন সঠিক প্রার্থী ছিলো। হঠাৎ করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম ১১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি নুরুল আলমকে ফোন করি। সে বলে বড়ভাই আমি তো আমার শালির বাসায় এসেছি। বাসায় ফিরে আপনাকে ফোন করবো। আওয়ামী লীগ যখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর মতো তার শ্বশুরের সাথেও আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু নুরুল আলমের সাথে আমার আর যোগাযোগ হয়নি। সে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং করোনায় মৃত্যুবরণ করে। এইভাবে আমার প্রায় সকল ঘনিষ্ঠ লোকের মৃত্যুসংবাদ একে একে আসতে থাকে। আমার ভগ্নিপতি এছাক সওদাগরের ছেলে এবং এছাক গ্রুপের সাবেক এমডি মো. ইউনুছ, তাঁর বোন নুরজাহান বেগম, কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু, ৩৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী হোসেন মুরাদ, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সৈয়দ মাহবুব, আহমদ শরীফ ভেদু সওদাগর ও তার স্ত্রী, মাষ্টার জানে আলম, প্রবাসী নুরুল হুদা, ৩৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শফি এরকম আরো অনেক আপন লোকের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছি। এসব মৃত্যুসংবাদ শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সারাদেশে এবং চট্টগ্রাম শহরে আমার অনেক ঘনিষ্ট লোক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা করোনায় মৃত্যুবরণ করেছে। আমার প্রতি রাত নির্ঘুম কাটে এবং মনে হয় পরের দিন আমি সূর্যের আলো দেখবো না। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে কেউ আমাকে সাহস দিচ্ছেনা, আমিও কাউকে সাহস যোগাতে পারছি না। কমার্স কলেজের আমার এক পুরানো ছাত্র কয়েকদিন আগে আমাকে ফোন করে। সে তার নাম বলে আমাকে প্রশ্ন করে, স্যার চিনতে পারছেন? আমি বলি, তোমার গলা শুনেই আমি চিনতে পেরেছি। সে বলে আপনি চোখের চিকিৎসার জন্য হায়দ্রাবাদে যেতে পারছেন না তো কি হয়েছে? আমি ব্যবসা বাণিজ্যে ভালো করেছি, আপনি হয়তো জানেন না। আপনার খবর শুনে আমি ব্যাংককের একটি আই হসপিটালের সাথে যোগাযোগ করেছি। আপনার কাগজপত্র আমার কাছে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেন। তবে একটা ঝামেলা আছে, ব্যাংকক গেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। মৃত্যু চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছে। আমি এখনো ওকে কিছু বলিনি। আমি রাতদিন ঘরে বসে ধ্যানমগ্ন থাকার চেষ্টা করি। তখন আমার বিচিত্র অনুভূতি হয়। মনে হয় আমরা মানুষেরা নিজ নিজ সত্তায় মহীয়ান। আমরা কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ গবেষক, কেউ উপাচার্য, কেউ আইন বিশেষজ্ঞ, কেউ উদ্যোক্তা, কেউ মন্ত্রী, কেউ শিক্ষাবিদ-আমাদের প্রত্যেকেই এক একটি বিশাল সত্তা। আমার মনে হয়, আমিও একটি বিশাল সত্তা। আমি আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে সেজদায় অবনত হই। তখনই মনে আসে, এখন যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে আমার সত্তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে কিন্তু আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর মহান সত্তা চিরস্থায়ী। এসব চিন্তা ভাবনার মধ্যে থেকে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। এই অবস্থার মধ্যে মজনু’র মৃত্যু সংবাদ আমাকে কাবু করে ফেলে। আমি জানিনা সামনে কি হতে যাচ্ছে? আমি জানিনা এক মিনিট পর কি ঘটবে, এক ঘন্টা পর কি ঘটবে, একদিন পর কি ঘটবে। সময় আমাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সামনে কি ঘটবে সে সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান নাই। তারপরেও আমরা ধনের অহংকার করি, জ্ঞানের অহংকার করি, ক্ষমতার অহংকার করি। বুঝতে পারছেন আমরা কতো বোকা?
সাখাওয়াত হোসেন মজনু আমার ঘনিষ্টজন ছিল। আমি তখন কমার্স কলেজ হোস্টেলে থাকি। মগ পুকুরের পাড়ে সেলিনা মঞ্জিল নামে একটি ভবনের বিপরীত দিকে সেই সময়ের নামকরা নেতা তোহা গাজী, সিটি কলেজ নৈশ ছাত্র সংসদের জিএস শফিউল্লাহ ভাড়ার বাসায় থাকতো। আলী রেজা চৌধুরীসহ অনেক নেতা সেখানে আসতেন। তার কাছাকাছি একটি বাসায় মজনু থাকতো। তার সাথে তৎকালীন সাংবাদিক ফজলুল হকের ছেলে ফেমিদুল হক, গোলাম সরওয়ার মজনু, জাকারিয়া চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন তোহা গাজীর বাসায় আসতো। আগ্রাবাদ ছাত্রলীগের এই কর্মীরা বিপ্লবী চরিত্রের ছিল। এখানে মাঝে মাঝে নঈমউদ্দিন ভাইকেও দেখতাম। মজনু ছোট ছিলো কিন্তু বেশ কর্মতৎপর ছিল। আমি এবং ডা. মাহফুজ ভাই মজনুকে খুব স্নেহ করতাম। পরবর্তী জীবনে মজনু আমার সাথে সাথেই ছিল। তার বউ মর্জিনা আখতার একজন কবি ও শিক্ষক। আমি সিটি কর্পোরেশনে প্রেষণে চাকুরি করেছি। তখন মর্জিনা সিটি কর্পোরেশনের স্কুলে শিক্ষকতা করতো। একদিন মজনু আমাকে বললো আপনার মেয়ে মর্জিনা প্রমোশন পাচ্ছে না। তাকে অবহেলা করা হচ্ছে। আমি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে কথা বলে মর্জিনার প্রতি যাতে জাস্টিস করা হয় সে ব্যবস্থা করেছিলাম। নিশ্চয়ই মর্জিনার এসব কথা মনে আছে। আমি মনে করি মজনু’র মৃত্যু আমাদের লেখালেখি জগতের মানুষের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। বিদায়, প্রিয় সাখাওয়াত হোসেন মজনু। মানুষ মরে যায়, রেখে যায় স্মৃতি। ফুল ঝরে যায়, রেখে যায় প্রীতি।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক : কিছু প্রস্তাবনা
পরবর্তী নিবন্ধনব জাগৃতি সংঘের ইফতার মাহফিল