বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সবচাইতে আলোচিত বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এবং বিদেশীদের নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা চোখে পড়ার মতো একটি বিষয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে বিরোধীদলগুলো আন্দোলনে লিপ্ত রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল এবং তার সাথে যুগপদ আন্দোলনে যুক্ত আরো ৩৬টি বিরোধী দল সরকারের কাছে এক দফা দাবি পেশ করেছে। এক দফা দাবির মূল বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বিরোধী দলগুলি কিছুতেই নির্বাচনে আসবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধী দলের অভিযোগ হল ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে সরকার কারচুপির আশ্রয় নিয়েছে। বিরোধী দলের ভাষায়, একটি হচ্ছে ভোটারবিহীন নির্বাচন, অন্যটি দিনের ভোট রাতে অনুষ্ঠানের নির্বাচন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা বিভিন্ন রকম প্রচারণা চালাচ্ছে। কোনো কোনো সমালোচক এমনও মন্তব্য করেছে যে, নরওয়েকে নিশীথ সূর্যের দেশ বলা হয়, এখন থেকে বাংলাদেশ হবে নিশীথ ভোটের দেশ। বিরোধী দলের এই সমালোচনার যথার্থতা কতটুকু তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল এবং নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা করেছিল। নির্বাচনে সুষ্ঠু পন্থা অবলম্বনের ঘাটতির জন্য বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের কিছু না কিছু দায় আছে। অপরদিকে বিদেশী রাষ্ট্র, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করে আসছে। বিএনপির কথাবার্তা শুনে মনে হয় পশ্চিমা বিশ্বের এই রাজনৈতিক চাপ বিএনপি‘র জন্য সহায়ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছে। তাদের ভিসা নীতি সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে এটা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিভিন্ন সভা সমাবেশে বিএনপি, আওয়ামীলীগের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তারা প্রধানমন্ত্রীকে কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে অভিহিত করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ কি সত্যি অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল? এবং শেখ হাসিনা কি একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক?
গণতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলতে হলে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃত্বের বিষয়ে জানা দরকার। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতা ছিলেন। মধ্য ষাটের দশকে তার মৃত্যুর পর দৈনিক ইত্তেফাক একটি বিশেষ সংখ্যা বের করেছিল। তখন ইলেকট্রনিক্স মাধ্যম না থাকায় এবং পত্রিকার প্রচার সংখ্যা সীমিত থাকায়, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা নামক এই বিশেষ সংখ্যাটি খুব গুরুত্ব লাভ করেছিল। এর শিরোনামে সোহরাওয়ার্দীকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন গণতন্ত্রই আমার জীবনের মূলমন্ত্র। শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে জনগণের রায়ই শেষ কথা। আজও ভারতবর্ষের রাজনীতিতে জওয়াহেরলাল নেহেরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এই সকল নেতাদের সারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্থান দেওয়া হয়। তিনি সারা জীবন গণতন্ত্র ও সততার চর্চা করেছেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার আগে সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই লাহোর প্রস্তাবে ভারত বিভক্ত হলে তাতে মুসলিমদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। পরবর্তী সময়ে লাহোর প্রস্তাবে বর্ণিত মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র বা স্টেটস শব্দটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সংশোধন করে। মুসলিম লীগ স্টেট শব্দটি যুক্ত করে। মূল লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাব থাকলেও, পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলের মুসলিম লীগ নেতারা কৌশলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা করে। ১৯৪৬ সালে বিশ্বযুদ্ধের চাপে ব্রিটিশরা ভারত বর্ষ থেকে চলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করতে থাকে। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন মন্ত্রী মিশনের তত্ত্বাবধানে ভারত বিভক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান এবং অমুসলিমদের জন্য ভারত স্বাধীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে আসে।
তখন প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলে ছয়টি প্রদেশের সবকটিতে মুসলিম লীগ হেরে যায়। শুধুমাত্র যুক্ত বাংলায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে বিজয়ী করে সরকার গঠন করেন। তখন বাংলাদেশের খাজা নাজিম উদ্দিনসহ নবাব পরিবারের লোকজন মুসলিমলীগের নেতৃত্বে ছিলেন এবং তারা সবসময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলায় সরকার গঠন না করলে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ কঠিন হতো। আপনারা যদি ১৯৪৬ এবং ৪৭ সালের ইতিহাস পর্যালোচনা করেন, তাহলে দেখা যাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কঠিন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে এই সময়টি পার করেছেন। এই সময় কলকাতা এবং নোয়াখালীতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁরা দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে মহাত্মা গান্ধী মূল ভূমিকায় ছিলেন।
মুসলিম লীগের এই ষড়যন্ত্র পাশ কাটিয়ে ১৯৪৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে বাধ্য হন। এই দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পশ্চিম পাকিস্তান শাখার সভাপতি ছিলেন নবাবজাদা নাসরুল্লাহ খান এবং পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছিল। আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং গণতান্ত্রিক ধারা সুরক্ষার জন্য। আজ যখন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে কোনো পথিক হেঁটে যায় এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহ তিন নেতার মাজারের দিকে তাকায়, তখন তারা অনুভব করে গণতন্ত্রের মানসপুত্র এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এখানে শুয়ে আছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ সোহরাওয়ারর্দী সাহেবের একান্ত অনুগত ও প্রিয় কর্মী ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দুই ছেলে, শাহেদ সোহরাওয়ার্দী এবং সাহাব সোহরাওয়ার্দীকে বাংলাদেশের মানুষ চিনে না। তার একমাত্র কন্যা আখতার সোলায়মানকেও বাঙালিরা চেনে না। কিন্তু তার পুত্রতুল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে মানুষ চেনে। গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গকারী এই নেতাকে মানুষ এখনো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। আওয়ামীলীগের ডিএন এর ভিতরে এবং তার শিরায় শিরায় রক্ত প্রবাহের সাথে গণতন্ত্র প্রবাহিত হচ্ছে। কেউ যদি আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্র বিমুখ রাজনৈতিক দল বলে, তখন খুব কষ্ট হয়। ইতিহাস না জেনে কথা বলা সঠিক রাজনীতির পরিচয় বহন করে না। আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্র, এক ও অভিন্ন। অন্যদিকে যারা এখন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আপনাদের কোনো কর্মকাণ্ডে বা কথাবার্তায় অগণতান্ত্রিক কোনো ভাব যেন প্রকাশ না পায়। নির্বাচন গণতন্ত্রের একমাত্র শর্ত নয়। নির্বাচন অবাধ হলেও মনোনয়ন যদি নীতির ভিত্তিতে না হয়ে ব্যক্তিনির্ভরভাবে হয়, তাহলে সেই নির্বাচন সুফল বয়ে আনবে না। প্রার্থী মনোনয়নের সময় হয়তো তৃণমূলের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে হবে অথবা কেন্দ্রে নির্বাচনী বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে।
নেতা বা নেত্রী; কলা গাছকে মনোনয়ন দিলে জনগণ কলা গাছকে ভোট দিবে এটা গণতন্ত্র নয়। মনোনয়নের মাধ্যমে সংসদে ব্যবসায়ী ও আমলা ব্যাপকহারে অংশগ্রহণ করতে পারে, এটা দলের রাজনীতিকে দুর্বল করে দেয়। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনের সময় অগণতান্ত্রিক আচরণ করে, রাতের আঁধারে ভোটের বাঙ পূর্ণ করে সেটা যেমন গণতন্ত্র নয়, তেমনি বিএনপি জামাত যদি সরকারের উপরে প্রভাব বিস্তারের জন্য বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয় এবং দেশে নির্বাচন বর্জনের হুংকার দেয়, সেটাও অগণতান্ত্রিক কাজ। বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কর্তৃত্ববাদী শাসক নামে অভিহিত করেছে। আমার মনে হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শব্দটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় নি। রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যবসায়ী প্রশাসনের যারা বিশেষজ্ঞ, তারা জানেন প্রশাসন দুই রকম হতে পারে। একটি কেন্দ্রীয়কৃত অন্যটি বিকেন্দ্রীকৃত। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয়করণ হচ্ছে না বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে, সেটা ব্যবসায়ীদের বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে কেন্দ্রীয়করণের যে প্রবণতা সেটা নিয়ে বিশদ আলাপ–আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার এবং অন্যান্য প্রশাসনিক স্তরগুলি এমনভাবে বিন্যস্ত করা আছে, যাতে সহজেই কেন্দ্রীয়করণ বা সেন্ট্রালাইজেশন হয়ে থাকে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর পর্যায়ে, মেয়র পর্যায়ে, মন্ত্রী পর্যায়ে, যেসব সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা সেগুলোও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চলে যায়। রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, এমনকি স্থানীয় সরকারের প্রকল্প প্রণয়ন সবকিছুর ব্যাপক সেন্ট্রালাইজেশন হয়। কোনো মন্ত্রী, কোনো আমলা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেন কিনা সেটাও ভেবে দেখতে হবে। এই কাজের জন্য আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা দায়ী নয়। বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তারাও একই কাজ করবে। অতীতেও তারা একই কাজ করেছে। এই কেন্দ্রীয়করণ দূর করার জন্য এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার অপবাদ ঘোচানোর জন্য ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। বিএনপির ভাষ্য মতে–শেখ হাসিনা জগদ্দল পাথর, এইটা ঠিক নয়। তবে আওয়ামী লীগ অথবা সরকার যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং বিকেন্দ্রীকরণের প্রতি মনোযোগী না হয়, তাহলে বিএনপি এই অপবাদ দিতেই থাকবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সব সময়, সব ক্ষেত্রে সত্য কথা বলতে হবে। মিথ্যা দোষারোপের সংস্কৃতি বাদ দিতে হবে। রাজনীতি মানে হল রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা। রাজনীতি মানে জনগণকে কণ্ঠস্বর দেয়া। রাজনীতি মানে জনগণকে কথা বলার সুযোগ দেয়া। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামীলীগকে জনগণমুখী হওয়ার অনুরোধ জানাবো। জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতিবিদ কখনো রাজনীতিতে সফল হতে পারে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট। সাবেক অধ্যক্ষ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ।