অনেক লিখেছি,কেউ মনে রাখেনি
২০২০ সালের এপ্রিল মাসের শুরু থেকে পুনরায় করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজারের অধিক দৈনিক। মৃত্যু সংখ্যা ষাটের কাছাকাছি। যাকে বলা হচ্ছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। সরকার আজ ৫ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী লকডাউন ষোষণা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে উভয় সংকট হলো সরকার লকডাউনের কড়াকড়ি করলে একদল বিশ্লেষক বলেন, এ অবস্থায় মানুষের জীবিকা চলবে কি করে, তারা কি খাবে। অন্যদিকে সরকার ব্যবস্থা না নিলে আরেকদল বিশ্লেষক বলেন সরকারের অবহেলার জন্য মহামারীতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করা কতো কঠিন তা আপনারা অনুমান করতে পারেন।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন দেশ বিপর্যস্ত তখন আমিও আমার ব্যক্তিগত অসুস্থতা নিয়ে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছি। চোখের সংক্রমণের জন্য কারো সাহায্য ছাড়া আমি কাজকর্মও করতে পারছি না। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, এখন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে চোখের সংক্রমণ সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামে চক্ষু হাসপাতাল অথবা শেভরন চক্ষু হাসপাতালে যাওয়াও করোনা সংক্রমণের দিক থেকে বিপজ্জনক। এই দুরবস্থার মধ্যে আমার দিন কাটছে।
১৯৭৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছি। ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণের পরে আমার মাথায় দুটি নতুন চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ১. অবসর গ্রহণের সময় আমার মনে হচ্ছিল আমি দেশের বড়ো বড়ো সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করার সময় শুধু বড়লোকের ছেলেদের সেবা করেছি। নিঃস্ব, অসহায় পরিবারের সন্তানদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমাকে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। আমি আড়াই বছর লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছি। একদিন আমি কলেজের অফিসে গিয়েছি, তখন দেখতে পাই আমার বিভাগের অনার্সের এক ছাত্র তার বাবাকে নিয়ে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে এসেছে। কেরানীকে তারা নগদ টাকা দিতে পারছে না। আমাকে দেখে ছাত্রটি অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে, কেরানী আমাকে ব্যাখ্যা করে বললো ছাত্রটির বাবার সুপারি বাগান আছে। গাছ থেকে সুপারি পেড়ে তারা পুকুরে ভিজিয়ে রেখেছে। তাদের আটটি পুকুর আছে এবং কয়েক বিঘা জমিতে সুপারির বাগান আছে। অভিভাবক আমাকে কাউনের হিসাবে সুপারির সংখ্যা বুঝানোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু তা আমার বোধগম্য হয়নি। তবে আমি এইটা বুঝতে পেরেছিলাম লোকটি ধনী। কিন্তু এখন তার হাতে নগদ টাকা নেই এজন্য ছেলেটির অনার্স পরীক্ষা দেওয়া হবে না। আমি কেরানীকে বললাম আপনি অফিস থেকে অথবা আমাদের সেমিনার ফান্ড থেকে টাকা এনে ওর ফরম পূরণ করে দেন। তারপর অ্যাকাউন্টস অফিস থেকে যখন আমার বেতনের বিল তুলবেন তখন টাকাটা সমন্বয় করে দিবেন। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে অ্যাকাউন্টস অফিস থেকে বিল করে আমরা বেতন তুলতাম।
চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে আমি দীর্ঘদিন ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং পরবর্তীকালে ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলাম। এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্সের ফরম পূরণের সময় কোন কোন দরিদ্র ছাত্র ছাত্রী টাকার অভাবে আটকে যেতো। দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক এম এ মালেক আমাকে বলেছিলেন যদি কোন ছাত্র ছাত্রীর লেখাপড়া টাকার জন্য আটকে যায় তাহলে আমার সুপারিশের ভিত্তিতে উনি টাকার বন্দোবস্ত করবেন। ফলে গরীবের সন্তানেরা টাকার জন্য আটকে গেলে আমি টাকার জন্য মালেক সাহেবকে সুপারিশ করতাম। তিনি কখনো না করেননি। এইসব অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছিল আমি শিক্ষাবিদ হিসেবে দরিদ্র মানুষের সন্তানের জন্য আরো অনেক সুযোগ সুবিধার সৃষ্টি করতে পারতাম কিন্তু আমার এ উপলব্ধি হয়েছিল অনেক দেরীতে। আমি সহযোগী অধ্যাপক থাকার সময় কয়েক বছরের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা বিভাগে প্রেষণে নিযুক্ত ছিলাম। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তখন ছিলেন চট্টগ্রামের নন্দিত মেয়র। তিনি দরিদ্র মানুষের সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। তিনি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও আগ্রহী ছিলেন। তার কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে আপনারা তা বুঝতে পারবেন। তিনি আমাকে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করার অবারিত সুযোগ দিয়েছিলেন। আজ চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে সিটি কর্পোরেশনের যে স্কুল ও কলেজগুলো রয়েছে এবং তাতে গরীবের সন্তানেরা লেখাপড়া করছে তা মহিউদ্দিনের অবদান। শুধু তা নয় তিনি গরিব ছাত্রছাত্রীদের আইসিটি শিক্ষারও সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমি মহিউদ্দিনের সাথে কাজ করতে পেরেছিলাম এটা আমার সান্ত্বনা। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের একজন শিল্পপতির সাথে আলাপের সময় আমি তাকে বলেছিলাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় খুব নিম্ন আয়ের লোকজনের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য আমি কিছু করতে চাই। যাদের আয় খুবই কম তারা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠায় না। তাদেরকে আমি ৫ম বা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা দিতে চাই। এই ভদ্রলোক আমার লেখা কয়েকটি বই পড়ে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তার মধ্যে রয়েছে দরিদ্র দেশ ধনী মানুষ, মিরাকল বাংলাদেশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, ২০২০ সালের বাংলাদেশ। এই বইগুলি তিনি আমার কাছ থেকে কিনে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে বাঙালিদের উপহার দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন গরিব মানুষের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি সহযোগিতা করবেন। আমি তখন আমার পেনশনের বড়ো অংকের টাকা পেয়েছিলাম, বিভিন্ন শিল্পগ্রুপে আমার ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল। আমি ২০০৭ সালে দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য একটা স্কুল করেছিলাম। আমাদের এটা স্মরণ রাখতে হবে আমরা যেন শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি না করি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষায় বৈষম্য হ্রাসের জন্য অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। ২. ১৯৯০ সাল থেকে আমি বই লেখা শুরু করি। আমার প্রথম বইয়ের নাম দরিদ্র দেশ ধনী মানুষ। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে মিরাকল বাংলাদেশ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের ম্যানাসক্রিপ্ট তৈরি করি। আমার চিন্তা ভাবনা ছিলো বাংলাদেশের তরুণ তরুণীদের মধ্যে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরি হবে এবং তাদের একটি অংশ আউটসোর্সিয়ের দিকে ঝুঁকবে। যেই ট্রেন্ড ভারতে এবং চায়নাতে লক্ষ্য করা গেছে। এটাই হয়েছে তাদের উন্নয়নের মূল রহস্য। আমি রাল্ফ সি ডেভিসের চায়না মিরাকল বইটি গভীরভাবে অধ্যয়ন করি। কি অদ্ভুত উপায়ে চায়না তাদের তরুণ উদ্যোক্তাদের কাজে লাগিয়ে আমেরিকার মতো মহাশক্তিশালী দেশকে ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছে। আমি দি ইকনোমিস্ট, ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের কিছু নিবন্ধ মনোযোগসহকারে পড়ি। ভারতের আইসিএফএআই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি গবেষণামূলক ম্যাগাজিন নিয়মিত পাঠ করতে থাকি। যার মধ্যে দি এনালিস্ট এবং দি এঙিকিউটিভ অন্যতম। চায়না-আইসিটি ছাড়াও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিনোম সিকোয়েন্সিং, বায়োটেকনোলজি এই সকল বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেছিলো। মাও সেতুং এবং দেনশিয়াও পিংয়ের আমল থেকে হাইগ্রেড টেকনোলজির ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করছিলো চায়না। রালফ এই বিষয়গুলি তুলে ধরে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আপনি যদি ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কলামগুলো পাঠ করেন তাহলে আপনি দেখতে পাবেন আমি তখন বলেছিলাম একদিন বাংলাদেশ হাই টেকনোলজি এবং আইসিটিতে মিরাকল দেখাবে। এই মিরাকলের মূলে রয়েছে তারুণ্যের শক্তি এবং উদ্যোক্তা সূলভ মনোবল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিজনেস প্রসেসড আউটসোর্সিং (বিপিও) এর হাইএন্ডে চলে যাবে। আপনি আমাদের গার্মেন্টস উদ্যোক্তাদের দেখেন তারা নিজগুণে এইটুকু পথ পাড়ি দিয়েছে।
আমি আমার নিজস্ব বিষয় ব্যবস্থাপনার বাইরে ঝঢ়রৎরঃঁধষরঃু রহ ড়িৎশঢ়ষধপব বিষয়ে লেখাপড়া করি। এজন্য ভারতের অনেক শহরে আমি বিভিন্ন মেডিটেশন সেন্টারে যাই। সেখানকার আধ্যাত্মিক গুরুদের সাথে কথাবার্তা বলি। আমাদের দেশে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের সাথে মতবিনিময় করি। পশ্চিমা বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে এথিক্স্ ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কোন কোন দেশে ব্যবস্থাপনা এমন পর্যায়ে পৌছেঁছে যে তাদের সংস্থাগুলিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদেরকে বসদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সুপারভিশন ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করতে দেখা যায়। এইসব বিষয়ে আমি ড. সোয়ানিনজারের সাথে আলাপ করেছি। তিনি ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক। তারা মনে করেন এথিক্স্ এবং আধ্যাত্মিকতার চিন্তা মাথায় রাখলে প্রশাসন পরিচালনা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। এথিক্স্ বিবর্জিত আমলা ও কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী আমাদের বিপর্যয়ের মূল কারণ। আমি চায়নার একজন অধ্যাপকের সাথে কথা বলেছিলাম তিনি আমাকে বলেছিলেন তুমি কি প্রশাসনের একটা আধুনিক সংজ্ঞা আমাকে বলতে পারবে? আমি হাসলাম কারণ আমি ঐ বিষয়ের ছাত্র। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন গধহধমবসবহঃ রং পড়হপবৎহ রিঃয সধহধমরহম ঃযব ড়িৎশ ফড়হব নু ঃযব ড়িৎশবৎ। তুমি কি ড়িৎশবৎ শব্দের অর্থ বুঝো? স্বভাবতই এর অর্থ শ্রমিক। তিনি বললেন মানুষের শ্রম এবং পশুর শ্রম দুটার মধ্যে পার্থক্য আছে। মানুষের শ্রম গতিশীল (উুহধসরপ) কিন্তু পশুর শ্রম স্থির (ঝঃধঃরপ)। ১০০ বছর আগে গরু ঘাস খেতো। এখনও খায়। এ খাওয়ার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসে নাই। কিন্তু ১০০ বছর আগে মানুষ যেভাবে খাবার খেতো এখন তাতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। যখন শ্রমিকেরা কোন কাজ করে তখন তারা দুটি বড়ো দায়িত্ব পালন করে। ক. তারা পণ্য উৎপাদন করে এবং খ. তারা উৎকর্ষ (ঊীপবষষবহঃ) পণ্যের সাথে যুক্ত করে। ফলে ২০০০ সালে যে মডেলের গাড়ি তৈয়ার হয় ২০২০ সালে সেটির আর কোন পুনরাবৃত্তি হয় না। অর্থাৎ শ্রমিকের মধ্যে এমন এক অভাবনীয় সৃজনশীল শক্তি আছে যার মাধ্যমে তার হাতে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে উৎকর্ষ যুক্ত হয়। এ কারণেই সভ্যতার বিকাশ ঘটছে। এ কারণেই এককালের সাঁকো ভিত্তিক বাংলাদেশে আজ টানেল এবং পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে। এই শ্রমিকের সৃজনশীল ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ। গার্মেন্টেসের কর্মীদের সেলাই ক্ষমতা সম্পর্কে এবং কলমের নীবের মতো তাদের আঙ্গুলের গঠন সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ। শিল্প উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার মূল্যায়ন আমরা করি না। আমি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কাছে অনুরোধ করি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলির উপরে পর্যবেক্ষণ এবং তার প্রয়োগ বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিন।
আমি গুরুতরভাবে অসুস্থ এই কথা আগেই বলেছি। আমার পক্ষে অন্য কারো সাহায্য ব্যতিত চলাফেরা করা সম্ভব হচ্ছে না। লেখার ব্যাপারেও কারো সাহায্য নিতে হচ্ছে। করোনার দাপটের কারণে আমি চিকিৎসাও নিতে পারছি না। আপনারা আমার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করবেন।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।