যেভাবে অনুমান করা হয়েছিল সেভাবেই ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে আপত্তি, ছোট খাটো সংঘর্ষ ছাড়া নির্বাচন মোটামুটি ভাবে সঠিক হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচন বর্জন এবং একদফা দাবিতে সরকারকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচন সম্পন্ন করায় অনেক বিশ্লেষকের চোখে বিষয়টি প্রশংসনীয় বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচন সুসম্পন্ন করার ব্যাপারে প্রথমত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। অতীতের অনেক নির্বাচন কমিশনের তুলনায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। যার ফলে নির্বাচনে কারচুপির খুব বেশি প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে না। বরং নির্বাচন কমিশন একজন সরকারি দলের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল সহ কয়েকজন নৌকা মার্কার প্রার্থীকে বড় অংকের জরিমানা করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিক রাখার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রশংসনীয়ভাবে কাজ করেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আওয়ামি লিগের দলীয় রাজনীতিবিদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন করায় বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দলের অবস্থান কী হবে। কেউ কেউ সমালোচনার চোখে বিষয়টি দেখছেন। তারা বলছেন যে ৬২ জন নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। আমার মনে হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ তাদের দলের বিধিবিধান শিথিল করে সুযোগ করে দেওয়া হয়। পদক্ষেপটি ভাল ফল দিয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ বিএনপির নির্বাচন বর্জনের কারণে নির্বাচন একপাক্ষিক হওয়ার এবং অংশগ্রহণবিহীন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যদিও নতুন নতুন অনেকগুলো দল গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও সুযোগ তারা সৃষ্টি করতে পারেনি। অনেকাংশে এই নতুন সৃষ্ট দলগুলির নেতারা জামানত হারিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যারা নির্বাচন করেছে তারা তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি করে নির্বাচনকে প্রাণবন্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের জন্য সাংগঠনিক সংকট সৃষ্টি হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ যারা নৌকা মার্কায় প্রতীক নিয়ে জিতেছেন তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের আওতায় আসবেন এবং তারা সংসদে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বা হুইপিং এর ক্ষেত্রে ফ্লোর ক্রস করতে পারবেন না। কিন্তু যারা স্বতন্ত্রভাবে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করে জিতেছেন সেই ৬২ জন স্বতন্ত্র সদস্যের জন্য ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর হবে না। সুতরাং তারা আলাদা মোর্চা বা গ্রুপ গঠন না করলেও সংসদে সরকারের কার্যক্রমের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন।
উপমহাদেশে ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে ঘটেছিল। ভারতে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সরকার গঠিত হওয়ার পরে জওয়াহেরলাল নেহেরু, জয়প্রকাশ নারায়ণকে কংগ্রেস থেকে বের হয়ে বিরোধী দল গঠন করার জন্য বলেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন যদি আপনারা একটি প্রাণবন্ত বিরোধী দল গঠন না করেন তাহলে কংগ্রেসকে ভবিষ্যতে বিরোধী দলের আসনে বসতে হবে। সেই দিক থেকে ৬২ জন, স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমার মনে হয়। এ পর্যন্ত যতটুকু দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপির প্রবল বিরোধিতা কাটিয়ে সরকার গঠন করে মন্ত্রিসভাও গঠন করে ফেলেছে। সুতরাং আওয়ামী লীগের সামনে যে চ্যালেঞ্জ ছিল সেটা অনেকটাই নিরসন হয়ে গেছে। এখন সামনের দিকে কীভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক এবং ফিসক্যাল সমস্যাগুলি মোকাবেলা করা হবে সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্ষেত্রেও ভারত, চীন এবং রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তি বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনকে প্রশংসা করেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিপূর্ণভাবে এই নির্বাচনের পক্ষে মত প্রকাশ করেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় থেকে সরকার বিপদের সম্মুখীন হবে বিষয়টা তত বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করছে না। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ শক্তি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং এ বছর নভেম্বরে তাদের নিজেদের নির্বাচন সামাল দেওয়ার জন্য তাদেরকেও ব্যস্ত থাকতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল অবস্থায় আছে। সেখানে কিশোর বন্দুকধারীরা জনগণের উপরে প্রতিদিনই গুলি চালিয়ে মানুষ মেরে ফেলছে। সুতরাং তারাও যে খুব সামাজিক স্বস্তিতে আছে তা নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে যারা সরকার পতনের আন্দোলন করেছিল, তাদের মধ্যে অনেকটা হতাশা কাজ করছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে কিশোর বয়সের যারা, যাদেরকে তরুণ প্রজন্ম বলা হয় তাদের মধ্যেও কিন্তু ব্যাপক হতাশা রয়েছে। তাই যদি বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সাথে বর্তমান মন্ত্রীসভা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে হয়তোবা আশার আলো দেখা যাবে। কিন্তু যদি সেটা সম্ভব না হয় তাহলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পৃথিবীর সকল দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিক দলের মধ্যে হানাহানি এবং এক দল, অন্য দলের রাজনীতিবিদকে সহ্য করতে অসম্মত হওয়ার পেছনে অনেক মানসিক কারণ আছে মর্মে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। এই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনেও সমপ্রতি অনেক গবেষণা হয়েছে। মানুষের মধ্যে যদি অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায় তাহলে যারা অর্থনীতির সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় তাদের মধ্যে হতাশা বিস্তৃত হতে পারে। সেটা বাংলাদেশে যেমন হতে পারে তেমনি উন্নত বিশ্বেও সেটা হতে পারে। রাজনীতির মধ্যে যখন হতাশা বিস্তৃত হয় তখন বৈষম্য আক্রান্ত সমাজের নিচু স্তরের মানুষ কী ধরনের আচরণ করে এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকরা বলছেন যে, তখন হতাশাগ্রস্ত মানুষ বা হতাশাগ্রস্ত রাজনীতিবিদগণ দুর্বল যুক্তি উপস্থাপন করে। যেমন আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগ করতে বলা হল। অনেকে মনে করেন যে বিরোধী দলের এই দাবি অনেকটা দুর্বল যুক্তি উপস্থাপনের সামিল। যদি জনসাধারণের ব্যাপক গণ বিপ্লব ঘটানো না যায় তাহলে শুধু মুখের কথায় সরকার পদত্যাগ করবে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। হতাশাগ্রস্ত মানুষ দুর্বল যুক্তি উপস্থাপন করার পাশাপাশি আগ্রাসী মনোভাবেরও পরিচয় দেয়। আমেরিকার মতো রাষ্ট্রে এখন তাদের তরুণরা বন্দুক হাতে নিয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন তারা মানুষ মেরে ফেলছে।
সুতরাং সাধারণ মানুষ হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে কি না এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে চিন্তাভাবনা করা বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমি মনে করি। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ার যে প্রবণতা সেটার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য অর্থ পাচার, বিদেশে সম্পদ ক্রয় এবং দেশে বিভিন্ন ভাবে কালো টাকার বিস্তারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। বৈষম্য হ্রাস করা একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। দুটি ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। একটি হল পণ্যের উর্ধ্বগতি থামানো, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সঙ্গে বাংলাদেশের টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টি জড়িত। ডলারের দাম যত বেড়ে যাবে, বাংলাদেশের অর্থের দাম ততই কমে যাবে। সুতরাং আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে সেটার প্রভাব পড়বে। রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের নির্ভরতা শুধু একটি বিশেষ পণ্য রফতানির উপরে। সেক্ষেত্রে রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্য করণেও প্রয়োজন রয়েছে। যদি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি সাফল্যের সাথে সরকার সমাধান করতে পারে, এবং যদি সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন এনে সরকার তরুণ সমাজের মধ্য থেকে হতাশা দূর করতে পারে তাহলে হয়তো এই সরকার সাফল্যের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে এবং বিরোধী দলের চাপ সত্ত্বেও এই ব্যবস্থায় যে নির্বাচন হয়েছে তা সাফল্যের সাথে কাজ করতে পারবে।
বিএনপির দৃষ্টিকোণ থেকে তারা বলছে যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রার্থী বাছাই করার যে সুযোগ থাকার কথা সেটি তারা পায়নি। কিন্তু বিএনপি নিজেই নির্বাচন বর্জন করে তাদের নিজেদের রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা কোন সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে কিনা সেটাও বিচার বিশ্লেষণ করার প্রশ্ন আছে। আমরা একটি নতুন সরকার পেয়েছি। আমরা মনে করি যে বাংলাদেশের জনগণ বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলির পক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মাঠে না নামায় আওয়ামী লীগ সহজেই তার পথ চলার রাস্তা মসৃণভাবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ,
চট্টগ্রাম; শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক।