আমার জন্ম হয়েছে ১৯৪০ দশকের শেষ দিকে। আমাদের এলাকার নাম হালিশহর। এক সময় এই বিস্তীর্ণ এলাকায় মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত। এই গ্রামীণ পরিবেশে আমাদের জীবন শুরু হয়েছিল। বর্তমানে শেখ মুজিব রোড তৎকালীন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ রোডের পশ্চিম দিকে সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় হালিশহর ইউনিয়ন কাউন্সিল পতেঙ্গা থেকে কাট্টলী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দুপুরবেলা আমরা যখন রাস্তায় খেলাধূলা করতাম তখন কাঠের কাঠামোতে এক চাকাওয়ালা ভ্যান গাড়ি ঠেলে এক ধরনের হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা এসে চোঙ্গায় হাঁক দিয়ে বাচ্চাদেরকে ডাকত। ওনার এই ভ্যানগাড়িতে ১টা মেশিন বসানো ছিল। হাতে চালানো এই মেশিনে চিনির শিরা মিশ্রণ করে এক ধরনের মিঠাই তৈরী করতো যার নাম হাওয়াই মিঠাই। বাচ্চারা এই মিঠাই কিনতো এবং তার চারদিকে প্রচণ্ড ভিড় লেগে যেত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয় রাজনীতিবিদরা আমাদেরকে হাওয়ায় মিঠাই খাওয়াচ্ছেন। বিএনপি এবং তার সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলি বলছে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। যদি আওয়ামী লীগের সরকার পদত্যাগ না করে তাহলে তারা পালাবার পথ পাবেনা। গত ১০ই ডিসেম্বর একজন বিএনপি নেতা বলেছিলেন ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে বেগম খালেদা জিয়ার কথায়। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর কিছুই হয়নি। তারপর ২৮ অক্টোবর ডেডলাইন ঘোষণা করে বলেছিল, তারপর সরকারের পতন ঘটবে। ২৮ অক্টোবরের পর কী হবে? একজন সাংবাদিক বলেছিলেন, ২৮ অক্টোবরের পর ২৯ অক্টোবর আসবে, অন্য কিছু হবে না। এখন দেখা যাচ্ছে ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি লাগাতার হরতাল অবরোধ করছে। কিন্তু সরকারের পতন হয়নি। এখন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে বিএনপি এবং তার সঙ্গে থাকা বিরোধী দলগুলির এই সকল ঘোষণা ভোটার এবং জনসাধারণকে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ানোর মতো রাজনৈতিক ঘোষণা কিনা এই বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
অপরদিকে আওয়ামী লীগ এবং তার জোটবদ্ধ দলগুলি বলছে তারা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করবে। তাতে কোনও রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক বা না করুক সেজন্য সরকার অপেক্ষা করবে না। এই অনুসারে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য আওয়ামী লীগ তিনশ আসনের বিপরীতে তিন হাজারের বেশি মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছে। এতে তাদের প্রায় ২০ কোটি টাকার মতো আয় হয়েছে। তারা বলছে সেই টাকা দলের রাজনৈতিক কার্যক্রমে ব্যয় হবে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীদের মধ্যে অভিনেতা, অভিনেত্রী, তারকা, খেলোয়াড়সহ ব্যবসায়ী, আমলা ও অন্যান্য পেশার মানুষ রয়েছে। জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছে। বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নাজমুল হুদা তৃণমূল বিএনপি গঠন করেছিলেন। সেই দল ও দলের জোট বিএনপি নেতাদের নিয়ে তিনশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্যে ৪৫০ মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছে। বিরোধী দলের জোটে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কল্যাণ পার্টি এবং আরও তিনটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন আরও অনেক রাজনৈতিক নেতা, বিশেষ করে সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিতে পারে। প্রয়োজনবোধে তফসিলের সময় পিছিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের সুযোগ সুবিধা করে দেওয়া হতে পারে। এখন বিএনপির সামনে দুটি পথ খোলা আছে; একটি হল নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া, অপরটি হলো আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তাদের দলীয় ব্যাপার। কিন্তু জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে দেশের সামগ্রিক অবস্থা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। এতে জনগণের কষ্ট বাড়বে।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। রাশিয়া, ভারত এবং চীন বাংলাদেশের নির্বাচনকে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের কথা বলে। তারা অন্য দেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এর বিরোধিতা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে তিনটি রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপ করতে বলেছে। ইউরোপের ধনতান্ত্রিক দেশগুলি বাংলাদেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। কোনও কোনও বিশ্লেষক মনে করছেন যে ইন্দো–প্যাসিফিক ইস্যুতে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বিদ্যমান। হয়তো মানবাধিকার, শ্রমিক স্বার্থ এবং অবাধ নির্বাচনের কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছে এবং তারা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনেও আগ্রহী। যদিও এই কথা তারা স্পষ্ট করে বলছে না। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত সরকার এবং বাইডেন সরকারের মধ্যে দ্বিমত স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে এখন। বাংলাদেশের রাজনীতি অস্থির হয়ে উঠলে তার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপরে। বাংলাদেশের রফতানির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে বাংলাদেশ বেশি পরিমাণে বাণিজ্যিকভাবে সম্পৃক্ত। একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়, সেটি হল বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ব্যাঙ্কক অথবা ভারতে যেতে চায়। বেশির ভাগ সাধারণ রোগী কলকাতা অথবা চেন্নাইতে গিয়ে চিকিৎসা করায়। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রোগী চীনে চিকিৎসার জন্য যায় না। বাংলাদেশের শ্রমিক কর্মসংস্থানের জন্য যে পরিমাণে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকাতে যেতে চায়, সেই পরিমাণে চীনে যেতে চায় না। বাংলাদেশ চীন থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে। কিন্তু বাংলাদেশে রফতানির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক অনেক পরিমাণে কম। ভারত চীনের সাথে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পুরোপুরি নেগেটিভ। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা একেবারেই অগ্রাহ্য করা যায় না। বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষ লেখাপড়ার জন্য বা গবেষণার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় যেতে চায় অথবা লন্ডনে যেতে চায়। কেউ বেইজিং যেতে চায় না। এই সম্পর্কটিও আমাদের চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে। বর্তমানে ইউক্রেন, রাশিয়ার যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের বর্বর হামলার পর বাংলাদেশের সাথে চীনের এবং রাশিয়ার ভূ–রাজনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।
গত ১৪ বছর সরকার পরিচালনা করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক বদলে গেছে। বাংলাদেশ একটি বিশাল সমুদ্রসীমার মালিকানা অর্জন করেছে। এই সমুদ্রসীমা দুটি বাংলাদেশের আয়তনের সমান। এখান থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ অনেক বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতে পারবে। স্যাটেলাইট প্রেরণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যার কারণে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স গণমাধ্যমগুলি অনেক সুবিধা পাচ্ছে। আই সি টি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। যার ফলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে স্মার্ট টেকনোলজি এবং এ আই’এর অগ্রসর করার কথা চিন্তা ভাবনা করতে পারেন। যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে অনেক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে সাধিত হয়েছে। যেমন পদ্মা সেতু, ঢাকা–কক্সবাজার রেললাইন, বিমানবন্দর সমপ্রসারণ এবং সড়ক ও সেতু প্রশস্তকরণ। বিদ্যুতের অনেক উন্নতি হয়েছে যার মধ্যে অনেকগুলি নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কয়লা এবং গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক খাতে গৃহনির্মাণ প্রকল্প, কম দামে খাদ্য বিক্রি, বিভিন্ন রকম ভাতা প্রদানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা জনগণের সাথে অনেক বেশি সম্পৃক্ত।
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় গত ১৪ বছরে শেখ হাসিনার বিশেষ কী অর্জন রয়েছে, আমি বলব করোনা মহামারি বিপর্যয়ের সময়ে ভ্যাকসিন প্রদানে শেখ হাসিনা সাফল্য দেখিয়েছেন। ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। সারা দেশের গ্রামীণ পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছেন এবং গৃহহীনদের ঘর দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পর শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করে বিশাল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তবে তৃণমূল পর্যায়ে ভোটারের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংযোগ বাড়াতে হবে। আমাকে যদি বলা হয় এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সামনে সবচাইতে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ কী, আমি বলব একটি গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বিতর্কিত হয়, তাহলে জাতিকে এবং রাষ্ট্রকে অনেক মূল্য দিতে হবে। তখন আর বিএনপি বা গণতন্ত্র মঞ্চকে দোষারোপ করার কোনও সুযোগ থাকবে না।
চাকরি জীবনে আমি আইসিএবি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছাত্রদের কোম্পানি আইন পড়াতাম। পশ্চিমা দেশগুলিকে বলা হয় Baby company culture in the body of a mature company; অর্থাৎ কোম্পানি যখন নতুন গঠিত হয়, তখন পরিচালকেরা তাকে নার্সিং করে, স্পুন ফিল্ডিং করে। কিন্তু এই কোম্পানির বয়স যখন বাড়ে, তখন কোম্পানিকে নিজস্ব শক্তি অর্জনের মাধ্যমে নিজে নিজে চলার সুযোগ করে দিতে হয়। তখন কোম্পানির পরিচালকরা হস্তক্ষেপ করে না। বাংলাদেশ এখন অনেক ম্যাচিউর, অনেক পরিপক্ক। এখন কোনো রাজনৈতিক নেতা যদি দেশের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিতে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তা অপরাজনীতি এবং ভুল প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিকে দেশকে নিয়ে যায়। আমরা রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে গঠনমূলক রাজনীতি চাই; হাওয়াই মিঠাই চাই না।
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ; শিক্ষাবিদ,
কলাম লেখক।