মধ্যপ্রাচ্যে হামাস এবং ইসরাইলের যুদ্ধে গাজায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ ইতোমধ্যেই রকেট এবং বোমার আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে। তিনশ তেষট্টি বর্গ কিলোমিটার এর গাজা উপত্যকায় ৩০ লক্ষ মানুষের বসবাস। তাদের উপর স্থল যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ইজরায়েল। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে যাদের হামলায় নারী, শিশুসহ সাধারণ ফিলিস্তিনিরা মৃত্যুবরণ করছে। যারা এখনও গাজায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে ছুটছে তাদেরও জীবিত থাকার সম্ভাবনা কম, যদি ইতিমধ্যেই হামাস ইজরায়েল যুদ্ধ বন্ধ না হয়। ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর ইসরাইলীরা নির্যাতন চালাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে তাদের পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তাদের ইসরায়েলি দাসত্বের আওতায় আনা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের কাছে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা বছরের পর বছর ধরে মার খাচ্ছে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তি; যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সকল রাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে। অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে তাদের টিকিয়ে রেখেছে। ওআইসিভুক্ত মুসলমান দেশগুলির পক্ষে ইসরাইলকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইসরায়েলের বসবাসকারী ইহুদিরা জ্ঞানবিজ্ঞানে অনেক অগ্রগামী। আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলি বর্তমানে কিছুটা অগ্রসর হলেও, অতীতে জ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিষয়ে তাদের অনীহা ছিল।
মালেশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বলছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্র হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগনকে কেন্দ্র করে ৬২ লক্ষ ইহুদি কাজ করে। তারা মার্কিন নীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে ১৫০ থেকে ২০০ কোটি মুসলমান রয়েছে। দুইশ কোটি মুসলমানকে মাত্র ৬২ লক্ষ ইহুদি কীভাবে হত্যা এবং নির্যাতন করতে সক্ষম হয় সেটি একটি ভেবে দেখার বিষয়। মাহাথির মোহাম্মদ মুসলিম উম্মাহকে প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মুসলমানদের বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। মুসলিমদের ব্যাপারে একটি ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছে যে, মুসলিম মানেই হল “টেরোরিস্ট বা সন্ত্রাসবাদী”। সেই অপবাদের কারণে মুসলমানরা পৃথিবীর যে কোনও দেশে, যে কোনও অবস্থায় বিপদের সম্মুখীন হন। আর যখন ফিলিস্তিনে, গাজায়, লেবাননে বোমার আঘাতে নিরীহ সাধারণ মুসলমানরা মৃত্যুবরণ করছে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের কাছে তা খুবই কষ্টদায়ক মনে হয়। আমার মনে হয় বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ফিলিস্তিনের এবং গাজার সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য তাগাদা দেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু গাজায় প্রকাশ্য ভাবে যে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে তারা ইসরাইলকে আরও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে সমর্থন দিচ্ছে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানির মতো দেশ তাদের নাগরিকদের ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মিছিল করা, বিক্ষোভ প্রকাশ করা এবং ইসরাইলের বিপক্ষে ঘৃণা প্রকাশ করার অনুমতি দিচ্ছে না। বিক্ষোভকারীদের উপরে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ফ্রান্সে বসবাসকারী ইহুদিদের সংখ্যা ৫ লাখ। ফ্রান্সে প্রায় ২০ লাখ মুসলমান বসবাস করে। ফ্রান্সকে আমি যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা একটি রাষ্ট্র হিসেবে মনে করতাম। কারণ ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ফ্রান্সে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির যে ধারা প্রবাহমান তাতে ফ্রান্সকে আমি সবসময় একটি লিবারেল রাষ্ট্র মনে করি। এখন দেখা যাচ্ছে ইসরায়েলের ব্যাপারে ফ্রান্সের ভূমিকা অত্যন্ত রক্ষণশীল। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানিতে নাৎসিরা যেভাবে অত্যাচার করছে, যুদ্ধাপরাধ করেছে ইসরাইলের নির্যাতন তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে গণহত্যা পরিচালনাকারীদের সমর্থন দেওয়ার নজির এটাই প্রথম।
হামাস কেন ইজরায়েলের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করছে এই প্রশ্নে অনেকে হামাস এর সমালোচনা করতে চাইছে। হামাস কেন আক্রমণ পরিচালনা করছে এ ব্যাপারে একটি অনুমান হলো, সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করেছিল। কোনও কোনও বিশ্লেষক বলছেন এই প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য হামাস অতর্কিত আক্রমণ করছে। হামাসের বক্তব্য হচ্ছে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে মেনে না নেওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের ইতি ঘটবে না। মূলত: আরবের ভূখণ্ড মুসলমানদের আবাসস্থল। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সরকার জোর জবরদস্তি করে ইসরায়েলের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। যেদিন সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় সেদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এবং ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থ পুষ্ট হয়ে এবং অস্ত্র সাহায্যের উপর নির্ভর করে ইজরায়েল ১৯৪৮ পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। মুসলমানদের ইবাদতের প্রধান কেবলা কাবা ও হেরেম শরীফ। তারপরে গুরুত্বপূর্ণ হল মদিনায় রসুল (দ🙂 এর মাজার শরীফ। এর পরই মুসলমানদের পবিত্রস্থান হচ্ছে মসজিদুল আকসা। যে মসজিদুল আকসায় মুসলমানদের নামাজ পড়তে ইসরায়েলি সৈন্যরা বাধা দিচ্ছে, মুসলমানদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। গণহত্যায় যেভাবে মানুষ খুন করে, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সৈন্যরা ঠিক তেমনই নির্যাতন চালাচ্ছে। ১৯৪৮ সাল থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য ফিলিস্তিনিদের অবিরত সংগ্রামের এবং অনবরত নির্যাতন সহ্য করার পরিপ্রেক্ষিতে হামাস এই অতর্কিত হামলা পরিচালনা করছে। কোনও কোনও বিশ্লেষক আভাস দিয়েছিলেন হামাসের হামলার ব্যাপারে ইরান অবগত ছিল। হামাসের হামলায় পরিকল্পনার যে গুণগত দিক ছিল, অস্ত্রশস্ত্রের যে প্রযুক্তিগত বিষয়, সবকিছু মিলিয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে এখন এইটাই প্রমাণ করেছে যে হামাস পৃথিবীর যে কোনও সুদক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের চাইতে শ্রেষ্ঠ।
এখন ইসরাইলের ৩ লক্ষ সৈন্য গাজায় প্রবেশ করে হামাসকে নির্মূল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। হামাস বলছে এই সব প্রচারণা ভুয়া। হামাসকে নির্মূল করতে পারবে না ইসরাইল কারণ হামাসের যোদ্ধাদের হাতে ট্যাংক বিধ্বংসী সহজে বহনযোগ্য অস্ত্র আছে। হামাস গাজার সরু রাস্তা গুলিতে এমনভাবে মাইন স্থাপন করেছে যা দিয়ে ইসরায়েলি সেনারা চলাচল করতে পারবে না। ভূগর্ভস্থ প্যানেল তৈরি করে তারা সেখানে ওত পেতে বসে আছে। সুতরাং মার্কিন এবং ব্রিটিশ নৌবহর আসা সত্ত্বেও, অত্যাধুনিক অস্ত্র ইজরায়েলকে দেওয়া সত্ত্বেও ফিলিস্তিনকে এবং লেবাননকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে; সেটা খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। যুদ্ধের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনও দেশ যদি জড়িয়ে পড়ে, তাতেও অবাক হওয়ার কোন কিছু থাকবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ, ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে এবং ফিলিস্তিনিদের নিন্দা করছে। এই পরিস্থিতি আশু পরিবর্তন হওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন হামাস গত দুই বছর ধরে এই হামলার নিখুঁত পরিকল্পনা করেছে। তারা বিভিন্ন উৎস থেকে অস্ত্র পেয়েছে। কিন্তু তারা প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়ে বা প্রযুক্তি আত্মস্ত করে নিজেরাই বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ এবং রকেট তৈরি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে তেল আবিবে আয়রন ডোম স্থাপন করেছে। এই ব্যবস্থাকে পৃথিবীর নিখুঁত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মনে করা হয়। হামাস তার দুর্বলতা খুঁজে বের করেছে। গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদকে কোনরকম গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যারা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ প্রযুক্তি এবং সামরিক বিজ্ঞানের মালিক, তারাও হামাসের আক্রমণের খবর আগে থেকে পায়নি।
রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা লেলিন আমেরিকাকে কাগুজে বাঘ বলতেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান যখন ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের রণতরী সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা সেই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে উপস্থিত থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের অনেকগুলি জাহাজ যেমন আল আব্বাস, আল শামস, পাক জমহুরিয়াত লিমপেট মাইনের আঘাতে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আটকাতে পারেনি। আমার মনে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইউরোপের রাষ্ট্রনায়করা ইসরায়েলের পক্ষে শক্তি জোগালেও এখন সকল দেশের সাধারণ জনগণ ফিলিস্তিনের গণহত্যা সমর্থন করেনা। হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলার কোনো সুযোগ নাই কারণ হামাস ফিলিস্তিনের জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সংগঠন। ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে সেই কামনা করি। আমার ধারণা হামাস ফিলিস্তিনের এই যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির উপরও পড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের এই অস্থিতিশীল অবস্থায় জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাবে। তার শিকার হবে বাংলাদেশ। করোনা এবং রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রভাব বিস্তার হয়তো বাংলাদেশ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আগামী দিনগুলোতে সঠিক অবস্থায় রাখা একটি কঠিন কাজ হবে। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে সেই অবস্থা আরও অবনতি হতে পারে। এটা বাংলাদেশ সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচন সন্নিকটে। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের অবস্থা দেখে সমঝোতার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদি সমঝোতা না হয় তাহলে সংঘাত হবে। আমরা অবশ্যই আশা করব সংঘাত এড়ানোর রাস্তা বের করে সমঝোতা করার চেষ্টা করতে হবে। সংঘাত পরিহার করুন। পশ্চিমা দেশগুলির আচরণ লক্ষ্য করুন। তারা ফিলিস্তিনের ব্যাপারে যা করছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে কখন কী করে, তার কোনও ঠিক নেই। যদি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাত হয়, তাহলে দেশের অবস্থা কি হতে পারে তা অনুমান করুন। রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অনুরোধ, আপনারা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, ক্ষমতায় টিকে থাকার কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা না করে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করুন। অর্থনীতি যাতে ভেঙে না পড়ে সেজন্য সকল দল মিলে সুরক্ষার ব্যবস্থা করুন। রাজনীতিবিদদের জেদাজেদির কারণে জনগণ যাতে কষ্টে না পড়ে। বিএনপি আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে পারবে আপাতত সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট যদি প্রকট আকার ধারণ, করে তাহলে সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য বিএনপির আন্দোলনের দরকার হবে না। ভবিষ্যতে কি হবে সেটা নির্ভর করছে গাজায় ইসরায়েল কি করতে চায়?
লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম; শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক।