বহমান সময়

ফজলুলু হক

| সোমবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। এই মাসের শেষের দিকে বড় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন। একজন সাংবাদিক আমাকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, বাংলাদেশের দুটি বড় রাজনৈতিক শক্তি দুই মেরুতে অবস্থান করায় শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি আমাকে বললেন যে, দুই মেরু যেমন এক হয় না, তেমনি দুই রাজনৈতিক শক্তি দুই দিকে থাকাই স্বাভাবিক। তারা কখনো এক হবে না। হয় আলাপ আলোচনার মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে, না হয় সংঘাতের মধ্য দিয়ে সেই সমস্যা শেষ হবে। আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এক দফা দাবি উপস্থাপন করে। আওয়ামী লীগকে পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থক দলগুলি বিএনপিকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছে। দুই মেরুতে থাকা এই দুই রাজনৈতিক শক্তির আলোচনার টেবিলে বসার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

পৃথিবীর প্রায় সকল বড় বড় রাজনৈতিক শক্তিধর দেশ এবং অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন দেশগুলি বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে। যদিও তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কথা বলছে। অনেকে সন্দেহ করছেন যে এর পেছনে ভূরাজনৈতিক পক্ষ অবলম্বনের প্রশ্নটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটি খুবই জটিল প্রশ্ন দেখা দেয়। বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু এবং অবাধনিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার। মানবাধিকারের ঘাটতি দেখা দিলে তারা বাংলাদেশের যে কোনও নাগরিককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করার কৌশল হিসেবে ভিসা নীতি প্রণয়ন করেছে। তার আগে তারা কিছু কর্মকর্তার উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলির প্রায় সবাই বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন চায়। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সকলেই অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। আওয়ামী লীগ এবং তার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলিও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এবং তারা এই ধরনের সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে বলে দাবি করছে। তাহলে নির্বাচন নিয়ে এই আন্দোলন কী জন্য হচ্ছে? বিদেশি শক্তিগুলির কি কোনও অন্য রকম উদ্দেশ্য আছে কিনা? অথবা দেশীয় রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য এসব কথা বলছে কিনা এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সামনে নির্বাচনের প্রশ্নে তিনটি শক্তি আলোচনায় আসতে পারে। প্রথমত পশ্চিমা বিশ্বের ধনী দেশ, দ্বিতীয়ত দেশের ভিতরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এবং তৃতীয়ত বাংলাদেশের জনগণ অথবা ভোটাররা। এই তিনটি শক্তির মধ্যেই সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকবে।

আওয়ামী লীগের বক্তব্য হচ্ছে গত দেড় দশক একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা ধারাবাহিকভাবে দেশের উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পর এক পর্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এমন শক্তিশালী হয়েছিল যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হয়। যার মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি নদীর নীচে সুড়ঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গের সাথে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, চট্টগ্রামকক্সবাজার রেল যোগযোগ, পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপন, কয়েকটা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কথা উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সারা দেশে সড়ক ও যোগাযোগ উন্নয়ন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তি ও আইসিটির ক্ষেত্রে অসাধারণ উন্নয়ন এসব সাফল্যের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগকে দিতেই হবে। বৈদেশিক নীতিমালার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও বাংলাদেশ তার অবস্থান ঠিক রাখতে পেরেছে সেটা আমরা এখন স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। ভূরাজনৈতিক বড় বড় খেলোয়াড়দের সাথে বাংলাদেশ সমান তালে পারদর্শিতার সাথে খেলতে সক্ষম হচ্ছে। এই প্রশংসা সমূহ আওয়ামী লীগের প্রাপ্য এবং সাধারণ জনগণ ও ভোটাররাও এই বিষয়গুলি জানে।

বর্তমান যুগের রাজনীতির সাথে ৫০ বছর আগের রাজনীতির পার্থক্য হলো আগে জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের এবং তার সাফল্যব্যর্থতার সঠিক তথ্য পৌঁছাতো না। যে রাজনৈতিক দল বা যে নেতা যত বেশি প্রচার করতে পারতেন জনগণ তাঁর সম্পর্কে তত বেশি জানতো। যে নেতা নিভৃতে কাজ করছেন, জনগণ তাঁর সম্পর্কে জানতে পারতো না। কিন্তু বর্তমান যুগে তথ্যপ্রবাহ অনেক গতিময়। প্রিন্ট মিডিয়া, খবরের কাগজ, সাময়িকী, ম্যাগাজিন এ সব তো আছেই; সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিদ্যুৎ গতিতে তথ্য প্রচার হয়। যা ঘটে মুহূর্তের মধ্যেই তা মানুষ জেনে যায়। যা ঘটবে বা ঘটতে পারে তাও মানুষ আঁচ করতে পারে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলি এমনভাবে তথ্য প্রচার করে যে অনেক সময় তথ্যের কনজিউমার হিসাবে ভোক্তাদের “ওভার ডোস” হয়ে যায়। এই অবস্থায় আমাদের দেশে আওয়ামী লীগের স্ব স্ব ফিল্ড সমর্থকেরা মনে করেন যে আওয়ামী লীগ যা বলবে, জনগণ তা বিশ্বাস করবে অথবা বিএনপি যদি মনে করে যে তারা যা বলবে জনগণ শুধু তাই বিশ্বাস করবে, এর চাইতে বড় বোকামি আর কিছু নেই। জনগণ দুনিয়ার ভেতরে বাইরে প্রবাহিত সব তথ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবহিত। এই বিশ্বাস মাথার ভিতর রেখে বিএনপি আওয়ামী লীগ বা অন্য সকল ডানপন্থী ও বামপন্থী বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। এটাকে বলা হয় “কার্ট বিফোর দি হর্স”।

আগেকার দিনে ঘোড়ার গাড়ি চলত আগে, ঘোড়ার পিছনে গাড়ি। এখন ঘোড়ার গাড়ি চলে; আগে গাড়ি, পিছনে ঘোড়া। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সকল শীর্ষ নেতাকে আমি বলব, মাথায় রাখবেন জনগণ আপনাদের আগে আগে হাঁটছে। জনগণকে বোকা বানিয়ে রাজনীতি করার যুগ এটা নয়। কোন দেশের কোন রাজনৈতিক নেতা এই কাজ করতে পারবে না। তথ্য প্রবাহের গতি যত জটিল হবে এবং দ্রুততর হবে, ততই ঘোড়া আগে চলবে গাড়ি পেছনে চলবে। বাংলাদেশের সরকারি দল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ বানানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে প্রথমবার সরকারে এসে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা যখন দেন, তার কিছু আগে শৈলী প্রকাশন থেকে আমার “ডিজিটাল বাংলাদেশ” নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। বইয়ের মধ্যে প্রকাশিত লেখাগুলি আমি নব্বইয়ের দশকে লিখেছিলাম। আমি কি আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশের অনুকরণে এই বই লিখেছিলাম? ভারতের রাল্ফ সি ডেভিস “চায়না মিরাকল” নামে একটি বই লিখেছিলেন। চীনের শাসনব্যবস্থা যাই হোক না কেন, মাও সে তুং এবং দেঙ শিয়াও পিং এর আমল থেকে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের থেকে চীন জৈব প্রযুক্তি, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিনোম সিকোয়েন্সিং, তথ্যপ্রযুক্তি ও তৎকালীন সময়ে অত্যাসন্ন প্রযুক্তিগুলি নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। আজকে চীন জৈব প্রযুক্তিতে চমক দেখাচ্ছে। এতই চমক দেখাচ্ছে যে, তাদের গ্রামীণ প্রান্তরগুলিতে শত শত বিঘা জমিতে অত্যাধুনিক এর চাইতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। স্যাটেলাইটের ব্যবহার, জিপিএস এর ব্যবহার, ড্রোনের ব্যবহার এমনকি এআই এর ব্যবহার ছাড়া ওদের কোনও তুলা চাষের মাঠ বাকি নেই।

বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি করে নিজেদের রপ্তানি আয় বাড়ায়। কিন্তু তাকে সুতা, কাপড় এবং পোশাকের অন্যান্য উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। চীন তৈরি পোশাকের চাইতে কাপড় এবং সুতা রপ্তানিও করতে সক্ষম। চীনের এই চমক প্রসঙ্গে যখন চায়না মিরাকল বইটি প্রকাশিত হয়, তখন তা আমাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে উন্নয়ন বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। তখন আমি পত্রপত্রিকায় জোরালো ভাবে কলাম লিখি। ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করি। তাদের প্রকাশনা বিভাগ আমাকে অনেক সাহায্য করে। সংক্ষেপ করে বললে যা দাঁড়ায় তা হলো, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ এ বড় বড় আই সি টি জোন প্রতিষ্ঠা করে তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে। ভারতের একটি রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইড়ু এবং তাঁর আই সি টি সাফল্য সম্পর্কে সবাই জানে। ভারত তখন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। নব্বইয়ের দশকেই ভারত বিজনেস প্রসেসড আউটসোর্সিং বা বিপিও লো এন্ডের পর্যায় সমাপ্ত করে বিপিও হাই এন্ডের দিকে ধাবিত হয়েছিল। ইউরোপ আমেরিকার ব্যবসায়ী জায়ান্টদের এমন কোনও পণ্য ভিত্তিক কল সেন্টার ছিল না যা ভারতের হায়দরাবাদের মাধ্যমে কার্যকর হতো না।

সেই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আমি মিরাকল বাংলাদেশ নামে একটি বই লিখি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে। এখানে আমি বলতে চাচ্ছি জনগণ সব কিছু জানে। এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের চাইতে জনগণ অনেক বেশি অবহিত। নতুন যুগের রাজনীতিতে যাঁরা নেতা হবেন, তাঁরা যেন জনগণকে পেছনে পড়ে থাকা আবর্জনা মনে না করে। রাস্তায় মারামারি করে এই যুগে সরকার হটানো যাবে না। যদি কোনও রাজনৈতিক নেতা এই বিষয়ে বিতর্ক করতে চান, তিনি তাতে রাজি হব। এখন সরকার হটানোর একমাত্র উপায় হল তাকে নির্বাচনে পরাজিত করা। সরকারের ব্যর্থতাগুলি খুব সহজে জনগণকে বলা যায়। তখন জনগণ বুঝতে পারবে সরকার চালাতে পারছে না। তারাই সরকারকে বিদায়ের আহ্বান জানাবে। বাংলাদেশের “স্মার্ট বাংলাদেশ” সম্পর্কে যাঁরা কথা বলেন তাদের কাছে আমি বলতে চাই, আজ থেকে ২০ বছর পরে যখন আপনাদের স্মার্ট বাংলাদেশের পরিপূর্ণতা আসবে, তখন প্রযুক্তি কী আজকের সময়ে আবদ্ধ থাকবে? ২০ বছরে প্রযুক্তি এতো উন্নত হবে যে, মানুষ সমুদ্রের তলদেশ থেকে চন্দ্রসূর্য পর্যন্ত চলে যাবে। ভারতের মতো দেশ সূর্যের চারপাশে ঘোরার জন্য মহাশূন্য যান পাঠিয়েছে। টেসলার গাড়ি নির্মাতা আমেরিকার নাসাকে রকেট বানিয়ে দিতে সক্ষম।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে? মানুষের মাথার ভিতর কি চিন্তা ঘুরপাক খায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তা জেনে নিতে পারবে। যদি এই প্রযুক্তির অগ্রগতি হয়, তাহলে সারা বিশ্বের রাজনীতি সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে। কে কী ভাবছে এটা যদি জানা যায়, তাহলে আপনারা বলুন রাজনীতি কোন দিকে ধাবিত হতে পারে? একসময় তথ্যপ্রযুক্তির সাফল্যের জন্য ভারতকে “শাইনিং ইন্ডিয়া” বলা হতো। এখন সে একই সাফল্যের জন্য বাংলাদেশকে “স্মার্ট বাংলাদেশ” বলা হচ্ছে। এই দুই ক্ষেত্রে রাজনীতি কাজ করছে। স্মার্ট বাংলাদেশের পর, পরবর্তী ধাপ কী হবে?

লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম;

শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার বিকৃতি : ক্রান্তি কালের সংকটের মূল উৎস
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ এর অন্ত্যমিল