বস্তি থেকে বহুতল ভবন সব জায়গায় অগ্নিঝুঁকি

আগুন নেভাতে বাধা সরু সড়ক, পানি সংকট ও কৌতূহলী জনতা : ফায়ার সার্ভিস নগরীর ভবনগুলোতে শীঘ্রই যৌথ সমীক্ষা : সিডিএ

হাসান আকবর | সোমবার , ৪ মার্চ, ২০২৪ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের সরু রাস্তা, পানিস্বল্পতা এবং কৌতূহলী জনতাই ফায়ার সার্ভিসের বড় অক্ষমতা। লোকবল এবং ইকুইপমেন্টের দিক থেকে মোটামুটি মানের সক্ষমতা থাকলেও আগুন নিভানোর অপরিহার্য উপাদানের অভাব সব আয়োজন ভণ্ডুল করার জন্য যথেষ্ট। সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়লে ফায়ার সার্ভিস অসহায় হয়ে পড়ে বলেও মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রামে বহুতল ভবন বাড়ার সাথে সাথে অগ্নিঝুঁকিও দিন দিন বাড়ছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, আগুনের মৌসুম ফিরে এসেছে। সতর্ক না হলে চট্টগ্রামের মানুষকেও বড় মূল্য দিতে হবে। জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীতে মোট ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১১টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ১ তলা ভবন রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫টি, ২ থেকে ৫ তলা উচ্চতার ভবন রয়েছে ৯০ হাজার ৪৪৪টি, ৬ থেকে ১০ তলা উচ্চতার ভবন রয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫টি। ১১ তলা থেকে ১৫ তলা ভবন রয়েছে ৪৩১টি, ১৬ তলা থেকে ২০ তলা উচ্চতার ৮৬টি, ২০ তলার বেশি উচ্চতার ভবন রয়েছে ১০টি। ইতোমধ্যে নগরীতে ৩৩ তলা উচ্চতার ভবন তৈরি হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে বড় ধরনের বস্তি রয়েছে ১২টি। মার্কেট বা বাজার রয়েছে ৪২টি। এই ১২টি বস্তি এবং মার্কেট অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

এগুলোর ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব মার্কেটে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে। বস্তিতে এক ঘর থেকে সংযোগ নেওয়া হয় আশেপাশের বহু ঘরে। তাছাড়া খোলা চুলা, এলপি গ্যাসের চুলাসহ নানাভাবে ঝুঁকিতে রয়েছে বস্তিগুলো।

এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিডিএ জানিয়েছে, তারা ফায়ার সার্ভিসকে নিয়ে নগরীর ভবনগুলোতে শীঘ্রই যৌথ সমীক্ষা চালাবে।

নগরীর বড় বড় ভবনগুলো নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছে ফায়ার সার্ভিস। এসব ভবনের অধিকাংশেরই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। নেই বিকল্প সিঁড়িও। লিফট থাকায় অনেক ভবনের মূল সিঁড়িও ব্যবহৃত হয় নানা কাজে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে এসব ভবন থেকে প্রাণ নিয়ে বের হওয়া কঠিন হবে বলে তারা মন্তব্য করেন।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ভবন নির্মাণে নিয়মকানুন মানা হয় কম। যেনতেনভাবে সিডিএ থেকে প্ল্যান পাশ করিয়ে ভবন নির্মাণ করা হয়। এসব ভবনে অগ্নিনির্বাপকের কোনো ব্যবস্থাই রাখা হচ্ছে না। নগরীর আগ্রাবাদে আজিজ কোর্ট নামের ৩৩ তলা উচ্চতার ভবন নির্মিত হলেও ফায়ার সার্ভিসের ১৮ তলা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এই ১৮ তলা ভবনে পৌঁছার জন্য ফায়ার সার্ভিসের যে ল্যাডার তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে কমপক্ষে ৪০ ফুট রাস্তা দরকার। ভবনগুলোর সামনে চল্লিশ ফুট রাস্তা থাকলেও তার বেশিরভাগই অবৈধ দখলে থাকে। এতে করে ফায়ার সার্ভিসের ইকুইপমেন্ট মুভমেন্টই ঝুঁকিতে পড়ে যায়। বস্তি এবং মার্কেটগুলোতে পানিবাহী গাড়ি পৌঁছানোর রাস্তা নেই। সরু রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না। লম্বা পাইপ টেনে ঘটনাস্থলে পানি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এতে করে আগুন নিভাতে ফায়ার সার্ভিসকে হিমশিম খেতে হয়।

বিষয়টির ব্যাখা করে চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা গতকাল আজাদীকে বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা হচ্ছে রাস্তা, প্রয়োজনীয় পানির অভাব এবং কৌতূহলী জনতা। এই তিনটি ক্ষেত্রে সক্ষমতা আনা গেলে চট্টগ্রামের অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলা করা আমাদের জন্য অনেক সহজ হবে। তিনি বলেন, আমাদের ১৮শ লিটার থেকে ২০ হাজার লিটার পানি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন গাড়ি রয়েছে। কিন্তু বড় গাড়িগুলো অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি না। আবার পানিও পাওয়া যায় না। ওয়াসার হাইড্রেন্টগুলো আমাদের কাজে লাগে না। আমাদেরকে নদী, পুকুর কিংবা খালডোবাসহ প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়, যা নগরীতে ক্রমে কমে আসছে।

আগুন নিভানোর ব্যাপারটি পুরোপুরি একটি সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীল মন্তব্য করে তিনি বলেন, কৌতূহলী জনতা যেভাবে ভিড় করে রাস্তা দখল করে রাখেন, মোবাইলে ভিডিও করেন, তাতে আমাদের সাপ্লাই চেইন ভেঙে যায়। আর অগ্নিকাণ্ডের সময় এই চেইন ভাঙা মানেই ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাওয়া।

পুরো চট্টগ্রামের তথ্য জানাতে গিয়ে আরেক কর্মকর্তা বলেন, এখানে মঞ্জুরিকৃত লোকবলের সংখ্যা ১ হাজার ২৬ জন। অথচ রয়েছে মাত্র ৭৭৫ জন। উদ্ধারকাজ চালানো কিংবা আগুন নিভানোর সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের যেসব ল্যাডার, ফোম টেন্ডার, টার্নটেবল ল্যাডার (টিটিএল) রয়েছে। এগুলো যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে সীমিত।

চট্টগ্রামের বহুতল ভবনগুলো মারাত্মক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অনেকগুলো বহুতল ভবনে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার তেমন ব্যবস্থা নেই। সিডিএ, ফায়ার সার্ভিস এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতিপত্র থাকলেও এসব ভবনে ঝুঁকি মোকাবেলা বা অগ্নিকাণ্ডের সময় জানমাল রক্ষা করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। নির্মাণকাজ শুরু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হলেও ভবনগুলো নির্মাণে অনুমোদনের শর্তগুলো পালন করা হয়নি। এতে করে চট্টগ্রামে শুধু বস্তি বা ঘিঞ্জি টাইপের মার্কেট নয়, অভিজাত অনেক ভবনও চরম ঝুঁকিতে আছে।

এ বিষয়ে সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেন, আমরা যৌথ সমীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছি। ফায়ার সার্ভিসকে সাথে নিয়ে নগরীর ভবনগুলোতে সমীক্ষা চালাব। যেসব ভবনে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়নি সেগুলোর ব্যাপারে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অনুমোদনহীন রেস্টুরেন্টসহ অননুমোদিত বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমজুদদারির বিরুদ্ধে ডিসিদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধস্ত্রী-মেয়ের সঙ্গে পাশাপাশি কবরে শায়িত শুল্ক কর্মকর্তা