বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা বললেই চলে আসে চুরুলিয়া গ্রামের সেই ছোট্ট দুখুমিয়ার কথা, আসানসোল শহরে রুটির দোকানে কাজ করা ছেলেটি, লেটোর দলে গান করা খুদে গায়কের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত এক জীবন। সে-জীবন পেরিয়ে কিনা ছোট্ট দুখু মিয়া নিজের সৃষ্টি দিয়ে নিজেকে আলাদা করে নেয় সবার মাঝখান থেকে। কন্ঠে তার, গাহি সাম্যের গান কিংবা বল বীর, বল উন্নত মম শির। বিদ্রোহ তার জীবনজুড়ে। বোহেমিয়ান, পাগলাটে, ক্ষ্যাপাটে জীবনের পাতা জুড়ে নানান গল্প-কাব্য, ঝড়ঝাপটা। তার কবিতা, গান, সাহিত্য, বিদ্রোহ এমনকি প্রেম ভালোবাসাও স্বাভাবিক জীবনের শৃঙ্খলে বন্দি হতে পারেনি কখনো। তাই তো তার কবিতা, গান, শিল্পের সব অনুষঙ্গের মতো তার জীবনে আসা নারীরাও আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বেশ কৌতূহলী চরিত্র। যেমন বিয়ের রাতেই ফেলে আসা কুমিল্লার দৌলতপুরের নার্গিস আমাদের সবার কাছেই পরিচিত নজরুলের নার্গিস হিসেবে। ঠিক তেমনি কিছু সময়ের জন্য তার জীবনে আসা ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী গণিতবিদ ফজিলতুন্নেসার প্রতিও আমাদের বেশ কৌতূহল। কে এই ফজিলতুন্নেসা? কেন তার জন্য নজরুল মরিয়া হয়ে যাবেন?
এই ফজিলতুন্নেসাকে জানতে এবং নজরুলের সঙ্গে তার সম্পর্কের গূঢ় রহস্য আবিষ্কার করতে আরেক কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘কবি ও রহস্যময়ী’ উপন্যাসটা শেষ করলাম সদ্য। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গদ্য ঝরঝরে, সাবলীল। পড়তে ভালো লাগে। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে কাজ করতে গেলে কিছুটা ঝুঁকি থাকে। চরিত্রের সত্যতা নিয়ে অনেকরকম মতামত থাকে। কিন্তু যখন তা উপন্যাস হিসেবে উপস্থাপিত হয় পাঠক দরবারে সেখানে নানা কল্পগল্পের সংমিশ্রণ থাকতেই পারে। সেইসব কল্পগল্পের নান্দনিক উপস্থাপনাই লেখকের মুন্সিয়ানা।
ফিরে আসি ফজিলতুন্নেসার কাছে। ময়মনসিংহ জেলার করটিয়ার কুমল্লীনামদার গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদ-এর বড় কন্যা ফজিলতুন্নেসা। গ্রামের স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করে। দু’বারই মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তি পেয়েছে। এরপর ভর্তি কলকাতার বেথুন কলেজে। বেথুন থেকে ডিস্টিঙ্কশনে বিএ পাস করে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। তৎকালীন সমাজে একটা মুসলমান পরিবারের মেয়ের এই যাত্রাপথ পাড়ি দেওয়া ছিল যুদ্ধজয়ের আখ্যান। সেই যাত্রাপথ পাড়ি দিতে ফজিলত পথদ্রষ্টা হিসেবে পেয়েছেন অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্য। তার মধ্যে অন্যতম ড. নলিনীমোহন বসু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ। সওগাত পত্রিকার সম্পাদক নাসিরুদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন, করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর মতো উদার এবং মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব।
সওগাত পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয় কাজী নজরুল ইসলামের। এই মোতাহারের মাধ্যমেই কবির রহস্যময়ী ফজিলতুন্নেসা সাথে পরিচয় হয় কবির। পরিচয়ের পর থেকেই ফজিলতের জ্ঞান, গরীমা, যুক্তি, তর্ক সব কিছুতেই আকৃষ্ট হন কবি। আর কবির সৃষ্টির প্রতি তো কম বেশি সকলেই আকৃষ্ট। ফজিলতও কবির গুণমুগ্ধ ছিলেন। ফজিলতের ঢাকার দেওয়ান বাজারের বাসায় কয়েকবার অতিথি হয়েও এসেছিলেন নজরুল। গান, কবিতায় অন্যদের মুগ্ধ করার বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন নজরুল। কিন্তু অন্যের গুণমুগ্ধ, রূপমুগ্ধ তিনিও কম হতেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন সময় কবি বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর বন্ধুরা বেশ ক’বার নজরুলকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রগতি’র আড্ডায়। এছাড়া জগন্নাথ হলে তারা নজরুলকে একবার সংবর্ধনাও দিয়েছিলেন।
এরকমই এক সাহিত্য সম্মেলনের মঞ্চে নজরুলের তেজোদ্দীপ্ত গান শুনে অন্য অনেকের মতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন ফজিলত। সেই একই অনুষ্ঠানে ফজিলতও একটি প্রবন্ধ পাঠ করার সুবাদে কুশল বিনিময় হয়েছিল নজরুলের সাথে। এরপর কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায় একান্তে আলাপের সুযোগ হয়।
নজরুলের সাথে ফজিলতের কথাবার্তা, আড্ডা, আসর এসব তখনকার রক্ষণশীল সমাজে চাউর হতে সময় লাগেনি। ফজিলত শক্ত ধারার মেয়ে বলে এইসব বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে চলছিলেন। কিন্তু যেদিন নলিনীমোহন স্যার নজরুলকে হস্তরেখা দেখানোর জন্য রেগে গেলেন তখন কিছুটা বিব্রতই হলেন ফজিলত। কৃষ্ণনগরে নজরুলের স্ত্রী, পুত্র, সংসার থাকার পরও তাকে নিয়ে রটনার শেষ নেই।
নজরুলের মতো বিখ্যাত মানুষ ফজিলতকে আলাদা গুরুত্ব দেয় এটা উপভোগ করতেন ফজিলত। নজরুলকে ভালোও বাসতেন বলেই মনে হলো। কিন্তু এক রাতে নজরুলের কান্ডজ্ঞানহীন বেহিসাবি পাগলামির জন্যই ফজিলতের সঙ্গে সম্পর্ক শুরুর আগেই সমাপ্তি হয়ে যায়। ফজিলত তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে ফিরিয়ে দেন বোহেমিয়ান নজরুলকে। ফজিলতের বিরহে পাগল পাগল নজরুলের জন্য মায়া হচ্ছিল খুব।
বন্ধু মোতাহারকে লেখা নজরুলের চিঠি দুটো পড়ে কিছুক্ষণ দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। এই চিঠি কি সত্যিই নজরুলের লেখা? নজরুলের লেখা হলে তো দারুণ একটা ব্যাপার। আর তা না হয়ে যদি লেখকের কল্পনা মিশ্রিত অনুভব থেকে লেখা চিঠি হয়, তবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে লেখক নজরুলের ভাষাটা ভালোই হৃদয়াঙ্গম করেছেন। চিঠির ক’টি লাইন উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ‘‘আমার কেবলই সেই হতভাগিনীর কথা মনে পড়ছে – যার উর্ধ্বে দাঁড়িয়ে ‘ডিউটিফুল’ আর পায়ের তলায় প্রস্ফুটিত শতদলের মতো ‘বিউটিফুল’। পায়ের তলার পদ্ম -তার মৃণাল কাঁটায় ভরা- দুদিনে তার দল ঝরে যায়, পাপড়ি শুকিয়ে পড়ে— তবু সে সুন্দর। দেবতা গ্রেট হতে পারে- কিন্তু সুন্দর নয়। তার সব আছে, চোখের জল নেই। তুমি মনে করতে পার মোতাহার— আমার চির জনমের কবি-প্রিয়া আমারই বুকে শুয়ে কাঁদছে তার স্বর্গেও দেবতার জন্য!’’
ফজিলত নজরুলকে মনে মনে যে ভালোবাসতেন সেই সম্ভাবনাটা পোক্ত হয় যখন বনগাঁর রানু সোমের প্রতি নজরুলের মন উচাটনের খবর শুনে বিষন্নতায় কাবু হয় ফজিলত।
নজরুল তার সমস্ত কবিতা এবং গানের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ভালোগুলো নির্বাচিত করে ‘সঞ্চিতা’ নামের বইটি ফজিলতকে উৎসর্গ করার কথাও জানিয়েছে। ফজিলত রাজি হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলত গণিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত যাওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন-এর কলকাতার বাসায় গেলে সেখানে নজরুলের সাথে তার আবার দেখা হয়। ফজিলতের বিদেশযাত্রা উপলক্ষে তার সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুলের স্বকন্ঠে গান গ ‘‘…. থেকো না স্বর্গ ভুলে/এ-পারের মর্ত্যকূলে/ ভিড়ায়ো সোনার তরী/ আবার এই নদীর বাঁকে।’ কী অসাধারণ পংক্তিসমূহ।
ফজিলত বিরহে বন্ধু মোতাহারকে লেখা আরেকটি চিঠিতে নজরুল লিখেন, ‘ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়- তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে?’’
‘শনিবারের চিঠি’ নামে পত্রিকার কাজ কি শুধু অন্যদের পেছনে লেগে থাকা ছিল নাকি! কারণ এর আগে বিভিন্ন লেখায় পড়েছিলাম এই ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার বিরূপ সমালোচনা করে কবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যেই বিভিন্ন লেখা ছাপাতো। ‘কবি ও রহস্যময়ী’ পড়ে দেখি কাজী নজরুল ইসলামও এদের রাহু বলয় থেকে বাঁচতে পারেনি। রানু সোমদের পাড়ায় ঘটে যাওয়া বিব্রতকর ঘটনা নিয়ে ঢাকা-কলকাতার সাহিত্য মহলে কবির পক্ষে-বিপক্ষে নানান কথা হচ্ছিল। কিন্তু শনিবারের চিঠি যেন কবি সাহিত্যিকদের নাজেহাল করেই বিরল আনন্দ পায়। লেখকের ভাষায়, ‘ ‘শনিবারের চিঠি’ নামের পত্রিকা তো অনেক আগে থেকেই লেগে আছে কবির বিরুদ্ধে। যতভাবে তাঁর চরিত্র হনন করা যায়, সব অস্ত্রই ব্যবহার করে চলছে তারা। এই গোষ্ঠীর পালের গোদা সজনীকান্ত দাশ নামের এক কবি। লোকটা প্রতিভাবান, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই প্রতিভা যত না নিজের সৃজনে, তার চেয়ে বেশি অন্যের ছিদ্রান্বেষণে ব্যয় করতেই যেন যাবতীয় আনন্দ তাঁর। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যখন সারা দেশে কাব্যপাঠকের মনে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে, তখনো একটা প্যারোডি ছাপিয়ে কবিকে হেয় করার, হাস্যাস্পদ করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিল এই শনিবারের চিঠি।’
ফজিলতকে শেষবারের মতো বিদায় জানানো হয়নি নজরুলের। নজরুল যখন ছুটতে-ছুটতে হাওড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে এসে পৌঁছাল তার অল্প আগেই ফজিলতের ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেলো। নজরুল এবং তার রহস্যময়ী ফজিলতকে নিয়ে যে অনেক গুঞ্জন ছিল তা আবার স্পষ্ট হয় বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া মোতাহারের কাছে যখন তরুণ লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ এর জিজ্ঞাসা, কৌতূহল থাকে তাদের সম্পর্কের ধোঁয়াশা নিয়ে।
তবে বইটার শেষে এসে পাঠক হিসেবে আমার একটা কৌতূহল রয়েই গেলো। স্বামী জোহার সাথে ফজিলতের দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিন্তু বিলেত থেকে ফিরে আসার পর নজরুলের সঙ্গে কি ফজিলতের আর যোগাযোগ হয়েছিল? নজরুল বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। এই সময়ে কি ফজিলত কখনো এসেছিলেন নজরুলকে দেখতে?
এরকম কিছু কৌতূহল চেপে রাখলে ঔপন্যাসিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘কবি ও রহস্যময়ী’ চমৎকার এক উপন্যাস। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে লেখক বেশ যত্ন করে এঁকেছেন নজরুলের রহস্যময়ীকে। তবে মনে হচ্ছিল উপন্যাসের কলেবর আরও দীর্ঘ হতে পারতো। নজরুলের প্রেয়সী ফজিলতের ব্যক্তিত্বের ধার দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় খালা, ফজিলতের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও নাতনীর নাম ফজিলত রেখে প্রমাণ করলেন ফজিলতের দীপ্তিময় আলোকছটা তার খালাকেও স্পর্শ করেছিল।
দু’একটা বানান বিভ্রাট বাদ দিলে বইটায় যত্নের ছাপ আছে। ৬৫ পৃষ্ঠায় একটা বাক্য অবশ্য অসম্পূর্ণ মনে হলো।
‘কবি ও রহস্যময়ী’ বইতে নজরুলের এত এত গানের কলি, কবিতার লাইন এসেছে বিভিন্ন কথোপকথনে তাতে করে এই বই পড়ে নজরুল সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ আছে পাঠকদের।
কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর প্রতি শুভেচ্ছা তার এই চমৎকার সৃষ্টির জন্য। তার কাছে আমরা নজরুল সম্পর্কে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই আশা করি। কবি ও রহস্যময়ী বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা। প্রচ্ছদ করেছেন মাসুক হেলাল।