মানুষের জীবনকে মাপার আসল মানদণ্ড কখনো কথার ঝংকার নয়, বরং তার কর্মের দ্যুতি। শব্দের ফুলঝুরি মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি কাড়ে, কিন্তু ইতিহাস গড়ে তারা–ই, যাদের হাতের পরিশ্রম ও হৃদয়ের সততা একসূত্রে গাঁথা। দেশপ্রেম যখন অন্তরের অনল হয়ে জ্বলে, তখন সে মানুষ নিজের চাইতেও বৃহত্তর হয়ে ওঠে; সমাজ তাকে সম্মানের আসনে বসায়। বলার চেয়ে করার সাহসী পদক্ষেপই প্রকৃত প্রমাণ, আর সেই প্রমাণের ভিতেই লুকিয়ে থাকে মানবমর্যাদার সর্বোচ্চ শিখর।
কথার মাধ্যমেই মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু কথার ব্যবহার যেমন আশীর্বাদ, তেমনি অপব্যবহার অনেক সময় অভিশাপেও পরিণত হয়। এই কথাটি কেবল একটি নীতিবাক্য নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। একজন মানুষ যদি এই তিনটি শিক্ষা মেনে চলে, তবে সে নিজের জীবন যেমন সমৃদ্ধ করতে পারবে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও হবে এক অমূল্য সম্পদ।
অতিরিক্ত কথা বলার অভ্যাস প্রায়ই মানুষকে সমস্যায় ফেলে। অযথা বেশি কথা বললে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়, দ্বন্দ্ব বাড়ে এবং অনেক সময় অশান্তি দেখা দেয়। অন্যদিকে সংযতভাবে অল্প কথা বললে মানুষ মর্যাদা পায়। কম বলা মানে নীরব থাকা নয়; বরং তখনই কথা বলা, যখন তা প্রয়োজনীয় ও অর্থবহ। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন–এমন কিছু না বলাই উত্তম যা নীরবতার চেয়ে ভালো নয়। সংযমী মানুষ কম কথা বলেই নিজের ব্যক্তিত্বকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে। বাংলার প্রবাদও তাই বলে–অল্প কথায় কৃপণ নয়, অল্প কথায় বুদ্ধিমানের পরিচয়।
যতটা গুরুত্বপূর্ণ কম বলা, ততটাই গুরুত্বপূর্ণ বেশি শোনা। শোনার অভ্যাস মানুষকে ধৈর্যশীল করে তোলে এবং জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। আমরা যখন অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি, তখন তাদের দুঃখ–কষ্ট, অনুভূতি ও সমস্যাকে ভালোভাবে বুঝতে পারি। এর মাধ্যমে সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং সমাজে সমঝোতা বৃদ্ধি পায়। সক্রেটিস একবার বলেছিলেন– প্রকৃতি আমাদের দুটি কান এবং একটি মুখ দিয়েছে, যাতে আমরা বলার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি শুনি। শোনার মাধ্যমেই মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে, জ্ঞান সঞ্চয় করে এবং সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়।
তবে কেবল কম বলা ও বেশি শোনাই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া। দেশপ্রেম মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ গুণ। এটি কেবল আবেগ নয়, বরং কর্তব্য, দায়িত্ব এবং আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়। যে মানুষ দেশকে ভালোবাসে না, সে কখনো প্রকৃত মহান হতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসই এর প্রমাণ। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন কেবল মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার কারণে। দেশপ্রেমিক মানুষ অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে না, কর ফাঁকি দেয় না, সমাজের সম্পদ নষ্ট করে না। বরং তারা সততা, দায়িত্ববোধ এবং ত্যাগের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখে।
শ্রোতা হিসেবে অন্যের মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন : মানুষের মহত্ত্ব কখনো কথার আড়ম্বরতে নয়, বরং কর্মের বাস্তবতায় প্রতিফলিত হয়। বলার চেয়ে করার মধ্যেই সত্যিকার প্রমাণ নিহিত থাকে। সততা হলো মানুষের আত্মার আলোকশিখা, আর দেশপ্রেম হলো তার হৃদয়ের মহত্তম শক্তি। এই দুই গুণ মানুষকে শুধু ব্যক্তি হিসেবে নয়, সমাজ ও জাতির জন্যও মহিমান্বিত করে তোলে।
যে হৃদয়ে সততার দীপ্তি জ্বলে, সে কখনো অন্ধকারে হারিয়ে যায় না; আর যে প্রাণ দেশপ্রেমে উদ্বেল, সে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে। তাই মানুষের প্রকৃত সম্মান ধনসম্পদে নয়, কথার চাকচিক্যেও নয়– তা নিহিত থাকে তার কমের্র সততা ও দেশপ্রেমময় জীবনযাপনে।
মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সজাগ রেখে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া : দেশপ্রেম মানে শুধুমাত্র দেশের প্রতি ভালোবাসা নয়, এটি হলো দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার অনুপ্রেরণা। কিন্তু যে কোনো কাজের সঙ্গে যদি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ না থাকে, তাহলে তা কখনোই সত্যিকারের দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারে না। এজন্য দেশপ্রেমী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা সজাগ রাখার অর্থ হলো সততা, দায়িত্ববোধ, ন্যায়পরায়ণতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা। একজন দেশপ্রেমী ব্যক্তি কখনো অনৈতিক পথ অবলম্বন করে নিজের স্বার্থ বা স্বীকৃতির জন্য দেশের ক্ষতি করে না। উদাহরণস্বরূপ, যে ব্যক্তি দেশ বা সমাজের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে সত্যিকারের সততা বজায় রাখে, তার কাজ অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়।
দেশপ্রেমী হওয়া মানে শুধুই ভালোবাসা নয়; এটি হলো কাজের মাধ্যমে দেশের সেবা করা। কিন্তু এই কাজটি তখনই প্রশংসনীয় হয় যখন ব্যক্তি নৈতিক ও মানবিক দিকগুলিকে প্রাধান্য দেয়। দেশের জন্য যখন আমরা নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিই, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখি, তখনই সত্যিকারের দেশপ্রেম উদ্ভাসিত হয়।
মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বজায় রেখে দেশপ্রেমী হওয়া হলো দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্বশীলতা প্রকাশের সঠিক পথ। এটি ব্যক্তি ও সমাজ দুই ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণে স্থায়ী অবদান রাখে।
সংক্ষিপ্ত কিন্তু অর্থবহ কথা বলার গুণ : কথা বলা মানুষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। তবে শুধু কথা বলা নয়, সংক্ষিপ্ত ও অর্থবহভাবে কথা বলা মানুষকে প্রভাবিত করে এবং বার্তাকে স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়। আজকের দ্রুতগতির জীবনে এই গুণটি বিশেষভাবে প্রয়োজন।
১ যিনি নিজের ভাবনাকে পরিষ্কারভাবে গুছিয়ে রাখেন, তিনি অল্প কথায় বড় বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন।
২ কথায় যুক্তি, সত্য ও প্রাসঙ্গিকতা থাকলে তা সংক্ষিপ্ত হলেও গভীর প্রভাব ফেলে।
৩. সংক্ষিপ্ত কথায় যদি সৌজন্য ও শ্রদ্ধা থাকে, তা শ্রোতার মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৪. আধুনিক জীবনে মানুষ কম সময়ে বেশি বোঝতে চায়; সংক্ষিপ্ত কথা এটিকে সহজ করে।
৫. সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থবহ কথা বলা মানুষের ব্যক্তিত্বকে উজ্জ্বল করে এবং অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়।
সংক্ষিপ্ত কথা বলার ক্ষমতা এক ধরনের শিল্প, যা চর্চা করলে জীবন ও সম্পর্ক উভয়ই সমৃদ্ধ হয়।
ভোগবাদী সমাজ সবসময় শব্দ (বিজ্ঞাপন, অফার, প্রলোভন) দিয়ে আমাদের মনোযোগ দখল করে। নীরবতা আমাদের এসব বিভ্রান্তি থেকে দূরে রেখে সরলতা শেখায়। কোলাহলের মধ্যে মানুষ সত্যিকারভাবে কিছু বুঝতে পারে না। নীরবতাই গভীর সত্য, সৌন্দর্য ও প্রেম উপলব্ধির পথ। ভোগবাদ ও শব্দময়তা আমাদের আসক্ত করে রাখে। নীরবতা মানুষকে এ আসক্তি থেকে মুক্ত করে প্রকৃত স্বাধীনতার পথে নিয়ে যায়।
আজকের সমাজে যখন বিভেদ, অশান্তি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংযম, ধৈর্য এবং দেশপ্রেম। কম কথা বললে আমরা অহেতুক দ্বন্দ্ব এড়াতে পারব, বেশি শুনলে অন্যকে বুঝতে শিখব, আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলে নিজেদের জীবনকে অর্থবহ ও মহৎ করে তুলতে পারব। প্রত্যেক নাগরিক যদি এই জীবনমন্ত্রকে অনুসরণ করে, তবে বাংলাদেশ একদিন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
মানুষের মহত্ত্ব কখনো কথার আড়ম্বরতে নয়, বরং কর্মের বাস্তবতায় প্রতিফলিত হয়। বলার চেয়ে করার মধ্যেই সত্যিকার প্রমাণ নিহিত থাকে। সততা হলো মানুষের আত্মার আলোকশিখা, আর দেশপ্রেম হলো তার হৃদয়ের মহত্তম শক্তি। এই দুই গুণ মানুষকে শুধু ব্যক্তি হিসেবে নয়, সমাজ ও জাতির জন্যও মহিমান্বিত করে তোলে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক