পচা শামুকে পা কাটে— গ্রামীণ প্রবাদ। কেন বলেছি? দেশের গত কয়েকদিনের ঘটনা প্রবাহ দেখে প্রবাদটির কথা মনে পড়লো। ভেবে দেখুন যে সরকার বিশ্বের বাঘা বাঘা সব দেশের পরামর্শকে পাত্তা না দিয়ে ও দেশের প্রায় সব বিরোধী দলের কথাকে অগ্রাহ্য করে টানা তিন মেয়াদে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলো, সেই সরকার মাত্র ১ মাসের অসংঘটিত ছাত্র আন্দোলনে কাবু হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলো। যার ফলশ্রুতিতে ৭৫ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের প্রধান শেখ হাসিনাকে লজ্জাজনকভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হলো এবং আওয়ামী লীগকেও চরম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হলো। প্রশ্ন হলো কেন এই নিরীহ আন্দোলনটি এতো দ্রুত ও কার্যকরভাবে এগিয়ে গেলো? প্রথমত ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকার সদ্য কৈশোর পেরানো এই জনগোষ্ঠীসহ দেশের জনগণের মনোভাবকে বুঝতে বা গুরুত্ব না দিয়ে চলা। কি তাদের চাহিদা কি তাদের মনোভাব এ বিষয়ে একটা ডোন্টকেয়ার মনোভাব দেখানো। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে দেশের বর্তমান প্রজন্মটি হলো বিশ্ব নাগরিকের প্রজন্ম। এরা হাতে থাকা মোবাইলটির মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে পুরা বিশ্ব ঘুরে আসে এবং উন্নত বিশ্বের জেনারেশনের সাথে তাদের নিজেকে তুলনা করে। তারা জেন জেড বা বিশ্ব নাগরিক হিসাবে নিজেকে ভাবে। কিন্তু যখন তারা দেখে চারিদিকে চরম অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, আধিপত্য, হত্যা সন্ত্রাস, ক্ষমতার অপব্যবহার ও পদে পদে প্রতিবন্ধকতা তখন তাদের মনে গভীর ক্ষত রেখাপাত করেছে। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসে তারা দেখেছে চরম বৈষম্য। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দ্বারা তারা প্রতি মুহূর্তে নিগ্রহের শিকার হয়েছে। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর দেখেছে, কর্মসংস্থানের জন্য তাদের চরম হাহাকার। এর মধ্যে যখন তারা দেখলো কোটা ও দুনীতির মাধ্যমে বিসিএসসহ সরকারি চাকুরির অধিকাংশ পদগুলো তাদের নাগালের বাহিরে চলে গেছে, তখন সরকারের প্রতি তাদের তীব্র ক্ষোভ জমে উঠেছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ক্ষমতার নিরঙ্কুশ কেন্দ্র হিসেবে নিজের অবস্থানকে সংহত করার জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করেন। নাগরিক অধিকারগুলো পরিকল্পিতভাবে সংকুচিত করেন।এই সময়েএকদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পারদ চড়েছে, অন্যদিকে গরিব ও ধনীর বৈষম্য বেড়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জনগণের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতিতে জনগণের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ব্যাংক কেলেঙ্কারি বেড়েছে। ঋণখেলাপিদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে ব্যাপক দুর্নীতি মিলিত হয়ে জনগণের অসন্তোষকে প্রচণ্ডভাবে উসকে দিয়েছে।
এই গণ–অভ্যুত্থানের সূচনা হয় জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাইকোর্ট বিভাগের একটা রায়কে কেন্দ্র করে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির নিয়োগে যে কোটাব্যবস্থা ছিল, তা আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সরকার বাতিল করে পরিপত্র জারি করতে বাধ্য হয়। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের মামলায় সেই পরিপত্রটা বাতিল করা হয়। অর্থাৎ ৫৬% কোটা আবার বলবৎ হয়।এই রায়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশায় বড় ধরনের আঘাত করে, তারা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে শুরু করে ও আন্দোলন শুরু করে। অন্য দিকে সরকারের দিক থেকে আপিল বিভাগে আবেদন করার যে পদক্ষেপ, সেটি ছিল শ্লথ। আপিল বিভাগের প্রতিকার পাওয়া যাবে সেই আস্থাও শিক্ষার্থীরা রাখতে পারছিলেন না। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন থেকে ফিরে এসে যে সংবাদ সম্মেলন করেন, সেখানে কিছু মন্তব্য ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপমানসূচক। এই বক্তব্য ঘিরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিলেন, ছাত্রলীগই আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে ছাত্রলীগ ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে আসছিল, তাদেরকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র অবস্থায় লেলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের উপর ছাত্রলীগের হামলার পর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে সরকার কারফিউ জারি করে ও সামরিক বাহিনীকে তলব করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তড়িঘড়ি করে বসে কোটা সংস্কারের ব্যাপারে একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু সেটি অনেক দেরিতে হয়ে যায়। এরি মধ্যে সরকারের সহিংস নীতির কারণে প্রায় ৪০০ মানুষ নিহত হয়, আহত হয় আরো কয়েক হাজার। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ১২,০০০ মানুষকে। তাতে ছাত্র ও নাগরিক সমাজ আরো বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সর্বশেষ দলীয় কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়। তারা সশস্ত্রভাবে আন্দোলন কারীদের ওপর হামলা করে।এটা করতে গিয়ে পুরো ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের আর বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে না। শেষে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। যার ফলশ্রুতিতে বিলুপ্ত হয় সরকারের।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার তিনটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান হলো আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ।এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভারসাম্যের মাধ্যমে একটি দেশ সফলভাবে এগিয়ে চলে। বলা যায়, যে দেশে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান যত বেশি কার্যকর সেই দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা তত বেশি সক্রিয়। নিয়ম হলো সংসদ আইন পাস করবে, নির্বাহী বিভাগ তা বাস্তবায়ন করবে আর বিচার বিভাগ পাসকৃত আইনটি সংবিধান ও আইন সম্মত কিনা সেটি দেখবে। কিন্তু সরকার দেশে সবকিছু আইন বিভাগের মাধ্যমে করতে চাইলো। যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। যার ফলে জনগণের ভোটের অধিকার ভূলুন্ঠিত হয়ে গেলো। দেশ স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে গেলো। অতিরিক্ত চাপের কারণে জনগণ চুপ হয়ে যাওয়ায় সরকার মনে করলো সব ঠিকভাবে চলছে। কিন্তু ভিতরে যে মানুষের চরম ক্ষোভ তৈরি হলো সেটি সরকার বোঝার চেষ্টা করলো না।
ভারত এই উপমহাদেশের একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি। তারা আরো বৃহৎ পরিসরের শক্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তাদের প্রতিবেশীদের সাথে প্রতিবেশী সুলভ আচরণের মধ্যে রয়েছে চরম ঘাটতি। ডমিনেটিং টেন্ডেসির কারণে তারা প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, চীন ও মায়ানমারের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেনি।এতে ভারতের প্রতি এসব দেশের জনগণের একটা চরম নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয়েছে। বলা যায়, শেখ হাসিনার বিয়োগান্তক এই পরিণতির জন্য প্রধানতম কারণ হচ্ছে ভারত। তাদের আধিপত্য বিস্তারের লালসার টোপে পড়ে শেখ হাসিনার সরকারের আজ এই দশা। যখন পশ্চিমা বিশ্ব সরকারকে সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছিলো, তখন ভারত চীনের জুজুর ভয় দেখিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে ম্যানেজ করে একতরফা ও একদলীয় নির্বাচনের পথে নিয়ে যায়। তারা চেয়েছিলো তাদের উপর অতি মাত্রার নির্ভরশীল একটি সরকার থাকলে তারা তাদের কথামত সরকারকে ব্যবহার করতে পারবে। যাতে তারা শতভাগ ফায়দা লুটতে পারে এবং সেটি তারা করেছেও। যার ফলশ্রুতিতে তাদের রেমিট্যান্সের পঞ্চম যোগানদার দেশ হয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ। বলা যায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ক্রাইসিসের জন্যও তারা দায়ী। এসবের ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগকে পড়তে হয়েছে চরম প্রতিকূলতার মুখোমুখি। যা শেখ হাসিনা ও ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য চরম অপমানজনক ও পরিতাপের বিষয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট