বর্ণমালার বর্ষাদিন

আলী প্রয়াস | বুধবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৫ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

সকালে ঘুম ভাঙতেই বর্ণমালা শুনল, টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। জানালার পাশে এসে দাঁড়াতেই দেখেচারদিকের পরিবেশ কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে, দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ, আর তার ওপর মেঘলা আকাশ। তালগাছের মাথায় জল বেয়ে পড়ছে, কাকগুলো পাতার আড়ালে বসে ঠুকঠুক শব্দে ডাকছে।

গেল সপ্তাহে ক্লাসে ফারিহা ম্যাডাম বৃষ্টি ও বর্ষার গল্প শুনিয়েছিল। বর্ণমালা ভীষণ আনন্দের সাথে শুনেছিল। ম্যাডাম বলছিলেন গতকাল ছিল শ্রাবণের দুই তারিখ। এ সময় নাকি ভারী বর্ষণ হয়। স্কুল থেকে ফিরতে না ফিরতেই শুরু হয়েছিল তুমুল বৃষ্টি। সে বৃষ্টি আর থামে না

বর্ণমালার খুব ভালো লাগে বর্ষাকাল।

সে জানে, বৃষ্টি মানেই খেলা, নৌকা, কাদা, আর মায়ের গরম খিচুড়ি।

ঘরের ভেতরে চুলার পাশে মা হাঁড়িতে ডাল আর চাল ফোটাচ্ছে। ধোঁয়ার ঘ্রাণে ভরে গেছে সব।

বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘এইবার মনে হচ্ছে মাঠ ভরে যাবে। নৌকা নামাতে হবে কদিনের মধ্যেই!’

বর্ণমালার চোখ টকটকে আনন্দে ভরে ওঠে। নৌকায় ভেসে বেড়ানোর স্বপ্ন যেন পাখা মেলল!

.

বর্ণমালার বাড়ি গ্রামের এক কোণে, যেখানে একপাশে পুকুর, আরেক পাশে ধানের ক্ষেত। বর্ষা এলেই সবখানে পানি জমে। কাঁচা রাস্তা বেয়ে ছোটছোট ধারা নেমে আসে মাঠে, পুকুর উপচে পড়ে খালের দিকে।

গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভিজে ভিজে মাঠে খেলছেকাদা ছোড়াছুড়ি, পানিতে নৌকা ভাসানো, পাটকাঠি দিয়ে তৈরি জলযান!

বর্ণমালা ছাতা হাতে বেড়িয়ে পড়ল উঠানে। তার খেলার সাথী তাকদির, আরিয়ান, আর মাহের আগে থেকেই পুকুরের ঘাটে। সবাই মিলে কলাপাতা ভাসিয়ে দিলো জলেযারটা বেশি দূর যাবে, সে জিতবে।

আকাশ গর্জে উঠল হঠাৎ। মেঘের গলায় যেন তুবড়ি ছুটল। ঝমঝম বৃষ্টি নেমে এলো আবার। সবাই ছুটল কোনার টিনের ছাউনির নিচে। সেখানে বসে মাহের বলল,

– ‘জানিস, এবার এত পানি হইছে যে আমাদের গরু ঘাস খাইতে পারে না!’

তাকদির মাথা দুলিয়ে বলল,

– ‘আমার মা বলতেছে, নদী নাকি ভাঙতে শুরু করছে…’

গতবছর এদিকটা তেমন বৃষ্টি হয়নি। ভরা বর্ষায়ও ডুবে যায়নি কোনো কিছু। কোনো কোনো বছর ডুবে যায় সারা এলাকা। বর্ষা যেমন আনন্দ আনে, তেমন কষ্টও বয়ে আনেবর্ণমালা এসব একটু একটু বুঝতে শেখে।

.

তৃতীয় দিনে বৃষ্টির তীব্রতা একটু কমল। চারদিকে শুধু পানি আর পানিমাঠ যেন নদীতে বদলে গেছে।

বাবা বলল,

– ‘চল, নৌকা নিয়ে বের হই। মামার বাড়ি যাই।’

বর্ণমালা লাফিয়ে উঠল! এমন তো সে বহুদিন চেয়েছে। মা ব্যাগে ভরে দিলো মুড়ি, খেজুর গুড় আর কয়েকটা কলা। মামা বাড়ি আরও পাঁচ গ্রাম পরে। বাবা বাঁশের বৈঠা হাতে কাঠের ছোট নৌকাটা ঘাটে ভাসিয়ে দিলেন।

নৌকা চলল কলকল করে। চারপাশে ধানের শীষ পানির নিচে ডুবে গেছে। খালের পাশে নলখাগড়া গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে পানির ওপর দিয়ে মাছ ছুটে যাচ্ছে। হাঁসের ঝাঁক ভেসে বেড়াচ্ছে আপন খেয়ালে।

বর্ণমালা ডুবন্ত গাছগাছালি দেখে ভাবেএই বুঝি কোনো ডাঙা ডুবে যাওয়া রাজ্য! হয়তো একটা জলপরি এসে বলবে, ‘চলো, আমাদের জলে নামো…’

.

নৌকা গিয়ে থামে মামার বাড়ির সামনে। ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়, পাশে লাউয়ের মাচাসবুজে ভেজা। উঠানে হাঁটু পানি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মামা, হাতে কলস।

বর্ণমালা নেমে বলে,

– ‘মামা, এই ঘরটা তো পুরো ভাসছে!’

মামা হেসে বলল,

– ‘এই তো বর্ষার মজা! ঘর থেকে নামলেই নদী!’

সন্ধ্যেবেলা মেঘ কিছুটা কেটে গেল, বৃষ্টির ধারা হালকা পড়ল। মামি বানালো হরেক নাস্তা। অগণিত ফসল নষ্ট আর মানুষের কষ্ট দেখে মামার চোখে চিন্তার রেখা অনুভব করল বর্ণমালা। তবু চিরায়ত বর্ষা আসে তার চিরন্তন সৌন্দর্য ও রূপ নিয়ে। খানিক পরে মামা গল্প বলতে শুরু করল

এক নদী ছিল, তার বুকে এক ঘুমন্ত রাজা, বর্ষা এলেই সে জাগে…’

বর্ণমালা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। তার স্বপ্নেও যেন রঙিন নৌকা, কলকল নদী, আর থৈ থৈ বর্ষা এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়অজানা কোনো রূপকথার দেশে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের ছবি
পরবর্তী নিবন্ধঅ্যান্টার্কটিকার রহস্যময় ব্লাড ফলস