বরেণ্য শিক্ষক প্রফেসর শায়েস্তা খানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

নিজামুল ইসলাম সরফী | সোমবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর শায়েস্তা খান গত ২২ অক্টোবর ২০২৫ সকাল ৫:১৭ টায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ১৯৯১ সালে আমি সরকারি কমার্স কলেজে একাদশ বর্ষে ভর্তি হলে প্রফেসর শায়েস্তা খান স্যারকে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন সৌম্য কান্তি ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় সুপুরুষ।

প্রফেসর শায়েস্তা খানের জন্ম ১৯৪২ সালে। তিনি চট্টলার কৃতি সন্তান, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও লেখক। চট্টগ্রাম মহানগর ক্রীড়া সংস্থার আজীবন সাধারণ সম্পাদক। বছর কয়েক আগে ‘৬০এর দশকে ছাত্র রাজনীতি এবং আমি’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক কলাম লিখে স্যার পাঠক সমাজে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি কীংবদন্তী হিসেবে আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন আমাদের মাঝে।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ২০২০ সালের স্যারের জন্মদিনে একটি কলাম লিখে আমাদের প্রিয় শিক্ষাগুরু প্রফেসর শায়েস্তা খানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। নাসিরুদ্দিন চৌধুরী লিখেছেন– ‘প্রফেসর শায়েস্তা খান একজন বর্ণাঢ্য চরিত্রের আকর্ষণীয় মানুষ। তিনি নানা গুণে গুণান্বিত একজন বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ। প্রফেসর সাহেবের শত শত ছাত্র (হাজার বললেও অত্যুক্তি হবে না) চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ছড়িয়ে আছেন। তাঁর বিখ্যাত ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আবদুল মান্নান, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, হাজী মহসিন কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ফজলুল হক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ তো রয়েছেনই।

প্রফেসর শায়েস্তা খান এর কথা উঠলে তিনি একজন শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াসংগঠক, আলোকিত মানুষ তাঁর এসব গুণের কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তিনি যশস্বী শিক্ষক ছাড়াও একজন বিশিষ্ট শিক্ষা সংগঠক ছিলেন। কমার্স কলেজের অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষতা ছাড়াও তিনি একাধিক কলেজ সংগঠিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাকে একজন শিক্ষা সংগঠক ও শিক্ষা প্রশাসকও বলা যায়। এদিক থেকে তিনি স্বনামধন্য অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে তুলিত হতে পারেন। রেজাউল করিম সাহেব সিটি কলেজ ছাড়াও আরও দু’টি কলেজের অধ্যক্ষ পদ অলংকৃত করেছিলেন। এর একটি ওমর গনি এমই এস কলেজ ও অপরটি কাট্টলী মোস্তফা হাকিম কলেজ।

অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান চান্দগাঁও এর বিখ্যাত হায়দার আলী নাজিরের বংশধর, তার পিতা আজিজ উল্লা খান লালদীঘির দক্ষিণ পাড়ের যে লাইব্রেরি, একসময় যার নাম ছিল বাকল্যান্ড ঘাট লাইব্রেরি, বর্তমানে ভাষা সংগ্রামী মাহবুবুল আলম চৌধুরীর নামে যার নামকরণ হয়েছে, সেই লাইব্রেরিতে শায়েস্তা খান সাহেবের পিতা লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

প্রফেসর শায়েস্তা খান অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কৃতিত্বপুর্ণ শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি শিক্ষকতায় যোগদান করেন এবং কমার্স কলেজসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। শায়েস্তা খান ৬২’র ছাত্র আন্দোলনের প্রধান নেতা। এম এ মান্নান, ফেরদৌস কোরেশি, শহীদ মুরিদুল আলম, এসএম ইউসুফ, ইদরিস আলম, আ ফ ম মাহবুবুল হক, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, আফতাব আহমদ, রায়হান ফেরদাউস মধু প্রমুখ তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন।

শায়েস্তা খান শুধু ক্রীড়া সংগঠক নন, তিনি একজন ক্রীড়া লেখক ও ভাষ্যকারও। তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনি নন্দনকানন তমিজ মার্কেট থেকে ‘দৈনিক মিছিল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রফেসর শায়েস্তা খান একজন সুলেখক। তার ভাষা সরস, রসালো, ফলে তার লেখা পড়ে স্বাদ গদ্যের আমেজ পাওয়া যায়।

প্রফেসর শায়েস্তা খান একজন আড্ডাপ্রিয়, দরবারী মানুষ। যেমন জহুর হোসেন চৌধুরী, চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী ও হাতি কোম্পানির রফিক মিয়া (শায়েস্তা খানের আঙ্কেল) দরবারী মানুষ ছিলেন। প্রফেসর শায়েস্তা খানের পর আড্ডা জমানো লোকের অভাব পড়বে এই শহরে। আহা অমন রূপবান, গুণবান মানুষটি যখন মধ্যমণি হয়ে দরবারে বসেন তখন কী যে ভাল লাগে।’

তৃকাল দ্রষ্টা প্রফেসর শায়েস্তা খান এ শহরের জ্ঞানবান মানুষটি জীবনের শেষ বেলায় এসে রচনা করেন স্মৃতিকথাপঞ্চাশ দশকের চট্টগ্রাম এবং আমার ছেলেবেলাগ্রন্থটি। গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে উঠে আসে পঞ্চাশ দশকের চট্টগ্রামের সামগ্রিক চালচিত্র, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিলুপ্তপ্রায় শহর চট্টগ্রামের এক অনবদ্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। এরকম একজন বরেণ্য শিক্ষকের চিরবিদায়ে আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রিড়াঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়। আমি আমার পরম শিক্ষাগুরু প্রফেসর শায়েস্তা খান স্যারের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভুল সিদ্ধান্তে স্বপ্নভঙ্গ হয়
পরবর্তী নিবন্ধনকশীকাঁথা : বাঙালির আত্মিক ঐতিহ্য