বন্দরের সেবার ট্যারিফ বাড়ছে চলতি মাসেই

২০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে দ্রব্যমূল্যে প্রভাব পড়বে বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি : বন্দর ব্যবহারকারী

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১২ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

চলতি মাসেই বাড়ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সেবার ট্যারিফ। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রায় চল্লিশ বছর পর বিভিন্ন সেবার ট্যারিফ বাড়ানো হচ্ছে। ট্যারিফ বাড়ানোর প্রক্রিয়ার একেবারে শেষ মুহূর্তের কার্যক্রম চলছে। চলতি মাসের মধ্যেই আইন মন্ত্রণালয় থেকে ট্যারিফ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নতুন ট্যারিফের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অযৌক্তিক। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের সাথে সাথে প্রতি বছর বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি পেয়েছে। ট্যারিফ বাড়লে দ্রব্যমূল্যের ওপর প্রভাব পড়বে। বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা একটি জাহাজ আবার ফিরতি পথের নোঙর তোলা পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫৬ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রতিটি জাহাজের সব ধরনের সেবার প্রয়োজন না হলেও অধিকাংশ সেবাই সমুদ্রগামী জাহাজগুলো গ্রহণ করে থাকে। বিদেশের কোনো বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছার পর জাহাজটিকে জেটিতে আনার জন্য পাইলট পাঠানো, টাগবোট সার্ভিস, পানি সরবরাহ, ক্রেন চার্জ, জাহাজ ভিড়ানো, জাহাজ থেকে কন্টেনার নামানো কিংবা ওঠানো, খোলা পণ্য ওঠানোনামানোসহ পণ্য ডেলিভারি পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রতিটি কাজের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট হারে মাশুল আদায় করে। মার্কিন ডলারে নেওয়া এই অর্থকে বন্দরের ট্যারিফ বা সেবার মূল্য বলা হয়।

বতর্মানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে ট্যারিফ আদায় করছে তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ অর্থবছরে ৫টি খাতে ট্যারিফ বাড়ানো হয়। তবে বাকি ৫১ খাতের ট্যারিফ আদায় করা হয় ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত হারে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় ট্যারিফ বাড়ানোর আলোচনা বা চিন্তাভাবনা করলেও তা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালে ট্যারিফ পুনঃনির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পায়নি। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাব দাখিল করলে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দিয়ে আন্তর্জাতিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ট্যারিফ কাঠামো তৈরির নির্দেশনা প্রদান করে। সরকারের নির্দেশনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ স্পেনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইডিএম কনসাল্টিং ও লোকিকফোরামকে ট্যারিফ কাঠামো নির্ধারণের পরামর্শক নিয়োগ করে। ওই প্রতিষ্ঠান নানা বিষয়ে পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন দেশের বন্দরের সেবার মূল্য পর্যালোচনা করে একটি প্রস্তাব দাখিল করে। ২০২০ সালে জমা দেওয়া ওই প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে পাঁচ বছর পর নতুন ট্যারিফ কাঠামো তৈরি এবং কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর সূত্র জানিয়েছে, নতুন ট্যারিফ কাঠামোর প্রস্তবনায় ১৮টি খাতে ট্যারিফ বাড়ছে ৬০ শতাংশের বেশি, ১৭টি খাতে ট্যারিফ বাড়ছে ২০ থেকে ৫৯ শতাংশ, ১৯টি খাতে বাড়ছে ২০ শতাংশ। দুটি খাতে ট্যারিফ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন প্রস্তাবনায় প্রতিটি ২০ ফুট কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ ১৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৩.১৫ ডলার, ৪০ ফুট কন্টেনার ২২.৫০ ডলার থেকে ৩৪.৮৩ ডলার, জাহাজ পাইলটিং চার্জ ৩৫৭ ডলার থেকে ৭০০ ডলারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সেবারও মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।

নতুন ট্যারিফ কাঠামো বন্দর কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় অনুমোদন প্রদান করে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ট্যারিফ কাঠামোর অনুমোদন দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে ফাইলটি অনুমোদন দিয়ে ট্যারিফ কাঠামোর বিস্তারিত তুলে ধরে আইন মন্ত্রণালয়ের জন্য ফাইল তৈরি করার নির্দেশনা প্রদান করে। বন্দর কর্তৃপক্ষ সেই ফাইল তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের পরই গেজেট প্রকাশিত হবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্র বলেছে, চলতি মাসের মধ্যেই বন্দরের নতুন ট্যারিফের গেজেট প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন ট্যারিফ আদায়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা বলেছেন, নতুন ট্যারিফের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অযৌক্তিক। বন্দর সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান। এভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো সবগুলো খাতে চড়া ট্যারিফ আদায় করলে শিপিং বাণিজ্যে খরচ বেড়ে যাবে, যার যোগান মূলত দেশের সাধারণ ভোক্তাদেরই দিতে হবে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল দৈনিক আজাদীকে বলেন, ট্যারিফ সহনীয় পর্যায়ে না বাড়ালে পুরো সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা না করে এভাবে ট্যারিফ বাড়ানো বিজনেস ফ্রেন্ডলি আচরণ হবে না। তিনি বলেন, আমরা মানছি, ট্যারিফ বাড়াতে হবে, এটি বাস্তবতা। কিন্তু এই বাড়ানোর হার যাতে আমাদের সমস্যার কারণ না হয় সেদিকে সজাগ থাকার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি।

তিনি বলেন, ব্যবসা সহজিকরণের কথা সবসময় বলা হয়। কিন্তু এটি ব্যবসা সহজিকরণের লক্ষণ নয়। প্রতিটি জাহাজ ডিলে হচ্ছে, অথচ ট্যারিফ বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য এটা ভালো হবে না।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহসভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ট্যারিফ বাড়ানো হলে আমাদের তৈরি পোশাক খাতসহ দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য মারাত্মক ধাক্কা খাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, চল্লিশ বছর ট্যারিফ বাড়েনি বলে যে কথাটি প্রচার করা হচ্ছে সেটি সঠিক নয়। মূলত প্রতি বছরই ট্যারিফ বেড়েছে। কারণ বন্দরের বিভিন্ন সেবার মূল্য পরিশোধ করা হয় মার্কিন ডলারে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের সাথে সাথে বন্দরের ট্যারিফ বেড়ে যায়।

মাহবুব চৌধুরী বলেন, ২০০৮ সালে যখন ডলারের দাম ছিল ৭৬ টাকা, তখন আমরা ৭৬ টাকা হারে সেবার মূল্য দিতাম। প্রতি বছর ডলারের দাম বেড়েছে। এখন সেটা ১২১ টাকা। আমরা এখন ১২১ টাকা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে আরো বাড়তি রেটে বন্দরের পাওনা পরিশোধ করছি। ফলে আমাদেরকে প্রতি বছরই প্রতিটি সেবার বিপরীতে বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। যতবার ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ততবার বন্দরের রেট বৃদ্ধি পেয়েছে।

ট্যারিফ বাড়ানো অযৌক্তিক এবং বন্দর ব্যবহারকারীরা এর ঘোরতর বিরোধী উল্লেখ করে একাধিক শিপিং ব্যবসায়ী বলেছেন, বন্দর তো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। প্রতি বছর বন্দর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করছে। গত বছরও সব খরচ বাদ দিয়ে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা ব্যবসা করেছে। এত ব্যবসার পরও জনগণ ভোগান্তিতে পড়ে এমন কাজ করার দরকার কী? নতুন ট্যারিফ কাঠামো কার্যকর হলে ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়বে, বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি। দ্রব্যমূল্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সহায়তা দিতেই মূলত ট্যারিফ বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন খরচ বেড়েছে। তাই ট্যারিফ না বাড়িয়ে কার্যক্রম চালু রাখা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। ৪০ বছর আগেকার কাঠামো দিয়ে ট্যারিফ আদায় করা হচ্ছে। এটি একটি অবাস্তব ব্যাপার। বন্দরের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ করতে হচ্ছে। তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কম মূল্যে বিশ্বের আর কোথাও শিপিং সেক্টরের সেবা পাওয়া যায় না। তারা বলেন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার ট্যারিফ কাঠামো চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং পোর্ট কেলাংয়ে নিয়মিত জাহাজ চলাচল রয়েছে। এসব জাহাজ ওই বন্দরগুলোতে বাড়তি ট্যারিফ দিচ্ছে, অথচ চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে অজুহাতের আশ্রয় নিচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাকসু নির্বাচন হতে পারে সেপ্টেম্বরে
পরবর্তী নিবন্ধআগামী নির্বাচনে তরুণদের জন্য আলাদা বুথ থাকবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা