দেশের আগামী একশ’ বছরের বন্দর হিসেবে বিবেচিত বে টার্মিনাল নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বে টার্মিনালের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু কিংবা এটি বাস্তবায়ন করতে হলে কোন পথে অগ্রসর হওয়া যাবে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বে টার্মিনাল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বিশ্বব্যাংক, সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ, দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ডসহ স্টেকহোল্ডারদের সাথে জরুরি বৈঠকে বসছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা। আগামী ১০ নভেম্বর ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, হালিশহরের উপকূলীয় এলাকার ৯৩৯ একর ভূমিসহ সাগর ভরাট করে গড়ে তোলা প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে বে টার্মিনাল গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ের বহু কাজই হয়ে গেছে। কিছুটা শ্লথ হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই বন্দরকে দেশের আগামীর ১শ’ বছরের বন্দর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের আদলে সাগর ভরাট করে উদ্ধার করে আনা ভূমিতেই নির্মিত হবে বে টার্মিনালের অবকাঠামো। এটিই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রিক্লেইমের ঘটনা হবে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। একই সাথে সাগরের স্রোতসহ পানির গতিপ্রবাহ ঠিকঠাক রাখতে বঙ্গোপসাগরে বাঁধ দিয়ে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হবে। ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল তৈরির কাজটি খুবই ব্যয়বহুল। বিশ্বব্যাংক এই দুইটি কাজের জন্য অর্থায়ন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে যে চ্যানেল তৈরি এবং ব্রেকওয়াটার নির্মাণে অন্তত সাড়ে তিনশ’ মিলিয়ন ডলার বা চার হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। বিশ্বব্যাংক এই টাকার পুরোটার যোগান দেয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পে সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ, ডিপি ওয়ার্ল্ডসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে।
ছাত্র–গণঅভ্যূত্থানে সরকার পতনের পর বড় বড় সবগুলো প্রকল্প নিয়েই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে। বিভিন্ন প্রকল্প পর্যালোচনাও করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়েও বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ডলার সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ও মাথায় রাখা হচ্ছে। অগ্রাধিকার ঠিক করে প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বে টার্মিনাল প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা এবং এটি বাস্তবায়নে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরির জন্যই মূলতঃ নৌ পরিবহন উপদেষ্টা জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছেন। তিনি প্রকল্পটির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত হয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলেও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে আগামী ১০ নভেম্বর বিকেলে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বে টার্মিনাল নিয়ে জরুরি বৈঠক বসছে। এতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ (পিএসএ), ডিপি ওয়ার্ল্ড, পিপিপি এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে বে টামির্নাল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হবে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে বে টার্মিনাল নির্মিত হওয়ার কথা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ বড় বে টার্মিনালের প্রয়োজনীয় ভূমির সংস্থান ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। দুবাই পোর্ট, আবুধাবী পোর্ট কিংবা সিঙ্গাপুর পোর্টের মতো প্রতিষ্ঠান বে টার্মিনালের স্বতন্ত্র টার্মিনাল নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রকল্পটিতে বিশ্বব্যাংক ৬৫০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ঋণসুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে বে টার্মিনালের ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রেকওয়াটার এবং চ্যানেল তৈরিতে ব্যবহার করা হবে।
বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো বলেছে, বে টার্মিনালে মোট চারটি জেটিসহ আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা রয়েছে। এর প্রথম দুইটি টার্মিনাল নির্মাণে প্রতিটির জন্য ১৫০ কোটি ডলার করে মোট ৩শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল (সিংগাপুর পোর্ট) এবং আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড বা দুবাই পোর্ট। এছাড়া আবুধাবি পোর্টস ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করবে। বে টার্মিনালের চতুর্থ টার্মিনালটিকে লিকুইড টার্মিনাল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এখানে জ্বালানি তেল খালাস এবং মজুদসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে কথাবার্তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পুরো প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা ঠিকঠাক করতেই জন্যই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে বলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান।