বে টার্মিনাল, মাতারবাড়ি টার্মিনাল এবং নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালসহ (এনসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে আজ প্রধান উপদেষ্টার দফতরে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। আগামী একশ বছরের বন্দর হিসেবে বিবেচিত বে টার্মিনাল পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগের ব্যাপারটি চূড়ান্ত। এখন কী প্রক্রিয়া এবং কি কি শর্তে সেটি করা হবে তা ঠিক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তবে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালেও বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হলে দেশ লাভবান হবে কিনা তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। মাতারবাড়ি টার্মিনালের ব্যাপারেও একই ধরনের আলাপ আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ চট্টগ্রাম বন্দরের প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ এবং পরিচালনার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এসব প্রস্তাবনায় শুধু বিদেশি বিনিয়োগ নয়, একইসাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারও জড়িত রয়েছে। সবগুলো বিষয় নিয়ে আজ রোববার প্রধান উপদেষ্টার দফতরে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে সূত্রে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মোট ৪টি কন্টেনার টার্মিনাল রয়েছে। চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (কন্টেনার ও বাল্ক) এবং পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি)। উপরোক্ত চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটি সবচেয়ে বড় এবং কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আধুনিক যন্ত্রপাতিতেও সমৃদ্ধ। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিলের প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয় করে এই টার্মিনাল নির্মাণ করে। টার্মিনালটির অবকাঠামোগত নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর বিদেশি একাধিক কোম্পানি নিজস্ব বিনিয়োগে ইকুইপমেন্ট স্থাপন করে টার্মিনালটি পরিচালনার আগ্রহ দেখিয়েছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছিল। কিন্তু পরে তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানের চাপের মুখে সেই দরপত্র বাতিল করা হয়। এতে করে পুরোপুরি তৈরি হয়েও চালু করা সম্ভব হয়নি এনসিটি। পরবর্তীতে সাত বছর পর বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় দুই হাজার কোটির বেশি টাকা খরচ করে এনসিটিকে ইকুইপমেন্ট সমৃদ্ধ করে। ডিপিএম পদ্ধতিতে এই টার্মিনালে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেককে। ডিপিএম পদ্ধতিতে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। সর্বশেষ বাড়ানো চুক্তির মেয়াদ গত ৭ জানুয়ারি শেষ হলে পুনরায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
এই টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে বিদেশি অপারেটরদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ডিপি ওয়ার্ল্ড পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার আগ্রহ দেখিয়েছে। এসব প্রস্তাব সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, দেশের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষা করে চট্টগ্রাম বন্দর এবং দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য লাভবান হলে সরকার এই টার্মিনালেও বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করতে পারে। পিসিটির মতো এনসিটিতেও বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করার ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।
বে টার্মিনালে বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি অপারেটরকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়াসহ সার্বিক বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। হালিশহরের উপকূলীয় এলাকার ৯৩৯ একর ভূমিসহ সাগর ভরাট করে গড়ে তোলা প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে বে টার্মিনাল গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ, ডিপি ওয়ার্ল্ডসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে।
সিঙ্গাপুরের আদলে সাগর ভরাট করে উদ্ধার করে আনা ভূমিতে নির্মিত হবে বে টার্মিনালের অবকাঠামো। এটি দেশে সবচেয়ে বড় রিক্লেইমের ঘটনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। একইসাথে সাগরের স্রোতসহ পানির গতিপ্রবাহ ঠিক রাখতে বঙ্গোপসাগরে বাঁধ দিয়ে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হবে। ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল তৈরির কাজটি ব্যয়বহুল। বিশ্বব্যাংক এই দুটি কাজের জন্য অর্থায়ন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, চ্যানেল তৈরি এবং ৬ কিলোমিটার ব্রেকওয়াটার নির্মাণে অন্তত ৬৫০ মিলিয়ন ডলার বা ৭ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। বিশ্বব্যাংক এই টাকার পুরোটার যোগান দেওয়ার কথা রয়েছে।
এই প্রকল্পে সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ, ডিপি ওয়ার্ল্ডসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো বলেছে, বে টার্মিনালে মোট চারটি জেটিসহ আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা রয়েছে। এর প্রথম দুটি টার্মিনাল নির্মাণে প্রতিটির জন্য ১৫০ কোটি ডলার করে মোট ৩শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর পোর্ট) এবং আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড বা দুবাই পোর্ট। এছাড়া আবুধাবি পোর্টস ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করবে। বে টার্মিনালের চতুর্থ টার্মিনালটিকে লিকুইড টার্মিনাল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এখানে জ্বালানি তেল খালাস এবং মজুদসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে কথাবার্তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
ইতোমধ্যে বন্দরের প্রকল্পে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার কাজ শুরু করেছেন। তারা কি কি শর্তে টার্মিনালগুলো বিদেশি অপারেটরকে দেওয়া যায় তা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনীয় গবেষণা করে রিপোর্ট প্রদান করবে। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই বিদেশি অপারেটরকে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
আজ প্রধান উপদেষ্টার দফতরে বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এসএম মনিরুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক দূত লুৎফে সিদ্দিকীর সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে। তিনি টার্মিনালগুলোর সার্বিক অবস্থা এবং বিদেশি অপারেটর নিয়োগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া বে টার্মিনাল নির্মাণ বা পরিচালনা করার মতো অবস্থা চট্টগ্রাম বন্দরের নেই। অথচ টার্মিনালটি দ্রুত নির্মিত হওয়া জরুরি। আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বিদ্যমান বন্দর আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের চাহিদা পূরণ করার সক্ষমতা হারাবে। তার আগে যদি বে টার্মিনাল অপারেশনে না আসে তাহলে চড়া মূল্য দিতে হবে। একইভাবে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরকে আক্ষরিক অর্থে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের অবকাঠামো দাঁড় করাতে বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। এটিকে স্বাগত জানানোর সময় এসেছে।